সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সূরা হুজরাতের শিক্ষা
- মুফতি শাব্বীর আহমদ
- ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
দুই.
আল্লাহপাক এটিকে অপছন্দ করেন। মানুষকে উপহাস ও বিদ্রুপ করা খুবই কুৎসিত কাজ এবং বড় গুনাহ। এতে মানুষের সম্মানহানি হয়, যা ঘোরতর অপরাধ। রাসূল সা: বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় সুদ হলো অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের মানহানি করা’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৭৬, সহিহাহ হাদিস : ১৪৩৩, ৩৯৫০, সহিহুল জামে হাদিস : ২২০৩, ২৫৩১, সহিহুত তারগিব হাদিস-২৮৩৩)।
ঠাট্টা-বিদ্রুপ মানুষকে নিন্দিত করে তোলে, মানুষের ব্যক্তিত্বকে হালকা করে দেয়। বিদ্রুপকারীরা পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, সর্বত্রই মানুষের চোখের কাঁটা হয়ে ওঠে। কারণ এই অভ্যাস অত্যন্ত জঘন্য হিসেবে বিবেচিত। অহেতুক ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কোনো সুশিক্ষিত, ভদ্র মানুষের কাজ নয়। পবিত্র কুরআনে এ ধরনের কাজকে মূর্খদের কাজ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সমাজবদ্ধ জীবনে অন্যের মনোকষ্টের কারণ হয়, এমন যেকোনো কাজ থেকে বেঁচে থাকার জোর তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে-ই যার জিহ্বা এবং হাত থেকে সব মুসলমান নিরাপদ থাকে’ (বুখারি, কিতাবুল ইমান, হাদিস নম্বর-৯)।
দোষারোপ না করা : একে অন্যকে দোষারোপ করা এবং অন্যের দোষ তালাশে ব্যস্ত থাকা, এগুলো এখন আমাদের যাপিত জীবনের অন্যতম পাঠ হয়ে গেছে। অথচ পৃথিবীতে দোষ-ত্রুটিমুক্ত কোনো মানুষ নেই। সুতরাং নিজের মাঝে দোষ রেখে অপরের ত্রুটি খুঁজতে যাওয়া বোকামি বৈ কিছুই নয়। কিন্তু মানুষ অপরের দোষ খুঁজে বের করাতে শান্তি অনুভব করে। এটি একটি জঘন্য কাজ। এ কাজ মানুষকে যারপরনাই কষ্ট দেয়। আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এটিও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা মুসলিমদের গিবত করবে না এবং দোষত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা তাদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার তার ঘরের মধ্যেই অপদস্ত করে ছাড়বেন (সুনানে আবু দাউদ-৪৮৮০)। অন্যের দোষ গোপনের ব্যাপারে নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন’ (মুসলিম-২৬৯৯, বুখারি-২৪৪২)।
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিন ব্যক্তির দোষ গোপন করল, সে যেন জীবন্ত প্রোথিত কোনো কন্যাকে কবর থেকে উঠিয়ে জীবন দান করল’ (মুসতাদরাকে হাকিম-৪/৪২৬, সহিহ ইবনে হিব্বান-২/২৭৫)।
মন্দ নামে না ডাকা : প্রতিটি মানুষের উচিত অপর ভাইকে সুন্দর নামে ডাকা এবং কারো নামকে বিকৃত করে কোনো ধরনের বিব্রতকর মন্তব্য না করা। মানুষের নামকে বিকৃত করে কিংবা অপমানমূলক নামে ডাকা মারাত্মক গুনাহ এবং জঘন্য কাজ। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি কোনো পাপের কাজ থেকে ফিরে এলে তাকে সে পাপের দিকে সম্বন্ধ করে বিভিন্ন নামে ডাকাও নিষেধ ও গর্হিত কাজ। যেমন- এ কাফের! ও ইহুদি! এ লম্পট! এ মাতাল! ইত্যাদি।
আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির রহ: বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে এমন সব শব্দ বা উপাধি দ্বারা ডাকাডাকি করো না যা সে শুনতে অপছন্দ করে’ (তাফসিরে ইবনে কাছির-৭/৩৭৬)।
হজরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ তকি ওসমানী পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তাসখির’-এর অর্থ কাউকে অপমান ও তাচ্ছিল্য করা। এমনভাবে কারো দোষ বর্ণনা করা, যাতে মানুষ তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে। এতে ওই ব্যক্তির অন্তরে ব্যথা লাগে। এ ধরনের কাজ অনেক রকম হতে পারে। যেমন- কারো চলাফেরা, ওঠাবসা, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গ করা, কারো শারীরিক গঠন ও আকার-আকৃতি নিয়ে কটূক্তি করা, তার কোনো কথা বা কাজের ব্যাপারে ঠাট্টা করা। চোখ, হাত-পা দিয়ে টীকা-টিপ্পনী করা অন্তর্ভুক্ত।
কথার মাধ্যমে দেয়া আঘাত মানুষ সবচেয়ে বেশি স্মরণে রাখে এবং এ আঘাত সর্বাধিক ব্যথাতুর হয়। কারণ আঘাতের ক্ষত ও ব্যথা দ্রুত সেরে যায়। কিন্তু কথার মাধ্যমে দেয়া আঘাত ও ক্ষতের নিরাময় সহজে হয় না।
মন্দ ধারণা, গিবত ও ছিদ্রান্বেষণ : ‘হে মুমিনগণ! অনেক রকম ধারণা ও অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারো গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না এবং তোমাদের একে অন্যের গিবত করবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটিকে তো তোমরা ঘৃণা করে থাকো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অধিক তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু’ (সূরা আল হুজরাত-১২)।
এই আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তায়ালা সর্বোচ্চভাবে একজন মুসলমানের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার আদেশ দিয়ে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের ব্যাপারে মন্দ ধারণা গিবত-পরনিন্দা ও অন্যের ছিদ্রান্বেষণ থেকে বারণ করা হয়েছে। পরস্পরের প্রতি ভালো ধারণা ও মুহাব্বাতের সম্পর্ক রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে সব প্রকার সংশয়-সন্দেহ থেকে দূরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এভাবেই কুরআনুল কারিম মানুষের হৃদয়জগতকে সব প্রকার অনুমান ও মন্দ ধারণা থেকে পবিত্র ও স্বচ্ছ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে এক মুসলিমের হৃদয়ে অন্য মুসলিমের জন্য মন্দ ধারণার পঙ্কিলতা না থাকে।
মন্দ ধারণা : মন্দ ধারণা থেকেই হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। আর হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অন্যায়ের জন্ম। প্রমাণহীন মিথ্যা ধারণা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে ফেলে। অহেতুক মন্দ ধারণা সম্পর্কে হাদিস শরিফে রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, ধারণা ভিত্তিক কথাই হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করো না এবং পরস্পর দুশমনি করো না; বরং হে আল্লাহর বান্দারা- তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও’ (বুখারি-৫১৪৩)।
গিবত : গিবত অর্থ পরনিন্দা। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা। হতে পারে দোষটি তার মধ্যে আছে। কিন্তু এই আলোচিত দোষটির কথা শুনলে সে নির্ঘাত মনে ব্যথা পাবে। তাহলে এটিই গিবত। ইসলামের দৃষ্টিতে গিবত করা কবিরা গুনাহ। অন্যান্য কবিরা গুনাহের মতো গিবতও একটি হারাম কাজ। তবে অন্যান্য কবিরা গুনাহের সাথে গিবতের পার্থক্য হচ্ছে- এটি হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হকের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
(এরপর আগামী দিন)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা