২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসলাম ও যুবসমাজ

-

যৌবনকাল মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ সময়ের ইবাদতের মর্যাদাও বেশি। স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা, শক্তি-সামর্থ্যে ভরপুর যৌবনের দিনগুলো জীবনের শ্রেষ্ঠ যা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। যৌবন মানেই বন্ধু, আড্ডা, গান, মাস্তি নয়। আল্লাহ ক্ষণিকের জন্য মানুষকে তার এই বিশেষ নিয়ামত দিয়ে পরীক্ষা করেন। যারা তাতে উত্তীর্ণ হবে, তারাই সফল। আর যারা তা অবহেলা করবে, তারা চিরব্যর্থ। যে ব্যক্তি তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করবেন, কঠিন কিয়ামতের দিন তিনি আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে তাঁর (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন; যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। (এর মধ্যে) ওই যুবক, যার যৌবন অতিবাহিত হয় আল্লাহর আনুগত্যে।’ (বুখারি, মুসলিম) আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। তাই তাঁর আনুগত্যেই জীবন অতিবাহিত করা যুবসমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে যৌবনকাল। এই সময়কে, আল্লাহপ্রদত্ত অফুরন্ত নিয়ামতও বলা চলে। এই সময়ে প্রতিটি মানুষের চিন্তার বিকাশ ঘটে এবং মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও ঘটে থাকে। এ জন্য, এই বয়সে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে বুদ্ধিবৃত্তিক হতে হবে। যেন ইসলামবিরোধী কোনো কাজের প্রতি স্বীয় অন্তর আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে। কেননা, যৌবনকালের সদ্ব্যবহার প্রতিটি মুসলিম যুবক-যুবতীর অবশ্য কর্তব্য। কারণ, কিয়ামত দিবসে যেসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে তন্মধ্যে যৌবনকাল অন্যতম। যেমন নবীজী সা: বলেছেন, ‘কিয়ামত দিবসে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হওয়ার আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে সরতে পারবে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে অভিবাহিত করেছে? তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে তা বিনাশ করেছে; তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে এবং তা কী কী খাতে খরচ করেছে এবং সে যতটুকু জ্ঞানার্জন করেছিল সে মোতাবেক কী কী আমল করেছে।’ (তিরমিজি-২৪১৬) এ জন্য রাসূলুল্লাহ সা: স্বয়ং নিজেই যৌবনকালের সদ্ব্যবহার করার জন্য উম্মাহর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহপ্রদত্ত জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের তাগিদ দিয়েছেন। কেননা, আল্লাহ মানব জাতিকে প্রেরণ করেছেন তাঁর ইবাদত ও নির্দেশিত পথে চলার জন্য। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ (সূরা আজ-জারিয়াত-৫৬) কিন্তু সমকালীন যুবসমাজের একাংশ ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে ভিন্ন ধারার উৎসব ও সংস্কৃতি লালনে মগ্ন হয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে চারিত্রিক অধঃপতন ঘটছে। যা নেহাতই দুঃখজনক। অনেকেই এহেন কর্মের দ্বারা অজান্তেই ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে পড়ছে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪০৩১) শুধু তাই নয়, ইসলাম ব্যতীত ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি গ্রহণে ও সর্বপ্রকার অশ্লীল কর্মকে আল্লাহ তায়ালা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। এমনকি যুবসমাজের মধ্যে যারা এসব কর্মের প্রচার ও প্রসার করে, তাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কঠোর হুঁশিয়ারিমূলক আয়াত রয়েছে।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ ( সূরা নূর- ১৯) এ জন্য মুসলিম জাতির সবার প্রতি ইলমে দ্বীন তথা ইসলামী শরিয়তের জ্ঞানার্জন করা ফরজ। যেন সবাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সব কাজে বৈধ-অবৈধ নির্ণয় করে চলতে পারে। হারাম তথা অবৈধ কাজে কেউ যেন জড়িয়ে না পড়ে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ওপর ফরজ।’ (সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব-৭২) এমনকি যুবসমাজের অন্তর্ভুক্ত যেসব যুবক-যুবতী তাদের যৌবনকাল আল্লাহর ইবাদতে কাটাবে এবং হারাম কাজ থেকে দূরে থাকবে, তাদের জন্য রয়েছে মহাসুসংবাদ, যা হাদিসে নবী সা: দ্বারা স্বীকৃত। অর্থাৎ, কিয়ামতের মাঠে হিসাব-নিকাশের বিভীষিকাময় মুহূর্তে আল্লাহর আরশের নিচে ছায়ায় স্থান পাবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না, সে দিন আল্লাহ তায়ালা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। যথাক্রমে- ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক; ২. যে যুবক আল্লাহর ইবাদাতের ভেতর গড়ে উঠেছে; ৩. যার অন্তরের সম্পর্ক সর্বদা মসজিদের সাথে থাকে; ৪. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে দু’ব্যক্তি পরস্পর মহব্বত রাখে, উভয়ে একত্রিত হয় সেই মহব্বতের ওপর আর পৃথক হয় সেই মহব্বতের ওপর; ৫. এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অবৈধ মিলনের জন্য) আহ্বান জানিয়েছে। তখন সে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি; ৬. যে ব্যক্তি গোপনে এমনভাবে সদকা করে যে, তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে না ও ৭. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আল্লাহর ভয়ে তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।’ (বুখারি-১৪২৩) এ জন্য প্রতিটি মানবের জীবনে যৌবনকাল গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। পাশাপাশি, রাসূলুল্লাহ সা: মুসলিম উম্মাহকে যে পাঁচটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে বলেছেন তন্মধ্যে যৌবনকাল অন্যতম। কারণ, আল্লাহর দেয়া এই নিয়ামতের অর্থাৎ যৌবনকালকে আল্লাহর পথে ব্যয় করা সব মুসলিম যুবক-যুবতীর অবশ্য কর্তব্য। যেমন জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির আগে গণিমত জেনে মূল্যায়ন করো : বার্ধক্যের আগে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার আগে তোমার সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে তোমার ধনবত্তাকে, ব্যস্ততার আগে তোমার অবসরকে এবং মরণের আগে তোমার জীবনকে।’ (সহিহুল জামে- ১০৭৭) তবে অশ্লীলতা, বেহায়পনা ও ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী কর্মকাণ্ড যুবসমাজ থেকে দূর করতে হলে সবাইকে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি নিজের সন্তান, পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ সবাইকে ইসলামী শরিয়তের অভিমত অবহিত করা কর্তব্য। তবেই দুনিয়াবি জীবনে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি, রহমত, শান্তি ও কল্যাণ লাভ সম্ভব হবে, তেমনি আখিরাতেও মহান রবের মাগফিরাত অর্জন সম্ভবপর হবে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ‘হে বিশ্বাস স্থাপনকারীরা! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো আগুন থেকে।’ (সূরা আত-তাহরিম-৬) যৌবনের উদ্যম ও শক্তিকে সঠিক পন্থায়, সঠিক কাজে ব্যয় করা হলে সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে। কারণ, যুবকরাই চালিকাশক্তি। তারা সুসংহত হলে গোটা জাতি সুসংহত হয়, তারা পথ হারালে গোটা জাতিই পথ হারায়। প্রত্যেক যুবকের উচিত তার যৌবনকে পাপমুক্ত রেখে আল্লাহর ইবাদতে সাজানো। আল্লাহকে ভয় করা। মানুষের উপকার করা। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা। গুনাহমুক্ত জীবন গড়তে যৌবন হিফাজত করতে হবে। হারাম কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement