২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পবিত্র ও অপবিত্র কথা

-


মানুষের কথা দুই প্রকার যথা : পবিত্র কথা ও অপবিত্র কথা।
পবিত্র কথা : ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের জন্য পবিত্র, সৎ ও সুন্দর কথা বলা বাঞ্ছনীয়। বিশেষত মুমিনদের জন্য পবিত্র, সৎ ও সুন্দর কথা বলা তার ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ যেই মুমিন সৎ, সত্য, পবিত্র ও সুন্দর কথা বলতে পারবেন না, বুঝতে হবে তার ঈমানে ত্রুটি আছে। কারণ মুমিন যেই কালিমার মাধ্যমে ঈমান নামক সবুজ অরণ্যে প্রবেশ করেন, সেই কালিমাকে আল কুরআন ‘কালিমাতুত তাইয়েবা’ বা ‘পবিত্র কথা’ বলে আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তুমি কি দেখছ না আল্লাহ কালেমা তাউয়েবার উপমা দিয়েছেন কোন জিনিসের সাহায্যে? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো জাতের গাছ, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে।’ (সূরা ইবরাহিম-২৪)

‘কালেমা তাইয়েবা’-এর শাব্দিক অর্থ-‘পবিত্র কথা’। এর মাধ্যমে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে- এমন সত্য কথা এবং এমন পরিচ্ছন্ন বিশ^াস যা পুরোপুরি সত্য ও সরলতার উপর প্রতিষ্ঠিত। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। এই উক্তি ও আকিদা কুরআন মাজিদের দৃষ্টিতে অপরিহার্যভাবে এমন একটি কথা ও বিশ^াস হতে যার মধ্যে রয়েছে তাওহিদের স্বীকৃতি, পূত-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবনের স্বীকৃতি। নবীগণ ও আসমানি সব কিতাবের স্বীকৃতি এবং আখিরাতের স্বীকৃতি। কারণ কুরআন এসব বিষয়কেই মৌলিক সত্য হিসেবে পেশ করে।
অন্য কথায় এর অর্থ হলো- পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা যেহেতু এমন একটি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত যার স্বীকৃতি একজন মুমিন তার কালেমা তাইয়েবার মধ্য দিয়ে থাকে, তাই কোনো স্থানের প্রাকৃতিক আইনের সাথে সংঘর্ষ বাধায় না, কোনো বস্তুর আসল, স্বভাব ও প্রাকৃতিক গঠন একে অস্বীকার করে না এবং কোথাও কোনো প্রকৃত সত্য ও সততা এর সাথে বিরোধ করে না।

তাই পৃথিবী ও তার সমগ্র ব্যবস্থা তার সাথে সহযোগিতা করে এবং আকাশ তথা সমগ্র মহাশূন্য জগত তাকে স্বাগত জানায়।
কোনো ব্যক্তি বা জাতি এই কালেমার ভিত্তিতে জীবনব্যবস্থা গড়ে তুললে প্রতি মুহূর্তে সে সফল লাভ করতে থাকে। সেটি তার চিন্তার পরিপক্বতা ও পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, জীবনধারায় মজবুতি, চরিত্রে পবিত্রতা, আত্মায় প্রফুল্লতা ও স্নিগ্ধতা, শরীরে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, আচরণে মাধুর্য, ব্যবহার ও লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় মুগ্ধতা ও সত্যবাদিতা, ওয়াদা ও অঙ্গীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কৃষ্টিতে ঔদার্য ও মহত্ব, সভ্যতায় ভারসাম্য, অর্থনীতিতে আদল ও ইনসাফ, রাজনীতিতে বিশ^স্ততা, যুদ্ধে সৌজন্যতা, সন্ধিতে আন্তরিকতা এবং চুক্তি ও অঙ্গীকারে বিশ^স্ততা সৃষ্টি করে। সেটি এমন একটি পরশ পাথর যার প্রভাব কেউ যথাযথভাবে গ্রহণ করলে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়।

সুতরাং মুমিন কখনো অশ্লীলভাষী, কদাচার, কর্কশ ও বদমেজাজি হতে পারে না। হজরত আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুমিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হতে পারে না, অভিসম্পাতকারী হতে পারে না, অশ্লীল কাজ করে না এবং কটুভাষীও হয় না।’ (তিরমিজি-১৯৭৭) আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি মেহেরবানি করা হবে।’ (সূরা হুজরাত-১০) ‘মানুষ খারাপ কথা বলে বেড়াক, তা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম করা হলে তার কথা ভিন্ন। আর আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও জানেন।’ (সূরা নিসা-১৪৮)

অপবিত্র কথা : আল কুরআনে অপবিত্র বাক্যকে ‘কালিমাতুল খাবিসা’ বা অসৎ বাক্য বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অন্যদিকে অসৎ বাক্যের উপমা হচ্ছে- একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই।’ (সূরা ইবরাহিম-২৬)
কালিমাতুল খাবিসা হলো কালেমা তাইয়েবার বিপরীত শব্দ। যদিও প্রতিটি সত্যবিরোধী ও মিথ্যা কথার ওপর এটি প্রযুক্ত হতে পারে তবুও এখানে এ থেকে এমন প্রতিটি বাতিল আকিদা বুঝায়, যার ভিত্তিতে মানুষ নিজের জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এ বাতিল আকিদা নাস্তিক্যবাদ, ধর্মদ্রোহিতা, অবিশ^াস, শিরক, পৌত্তলিকতা অথবা এমন কোনো চিন্তাধারাও হতে পারে যা নবীদের মাধ্যমে আসেনি।

অন্য কথায় এর অর্থ হলো- বাতিল আকিদা যেহেতু সত্যবিরোধী তাই প্রাকৃতিক আইন কোথাও তার সাথে সহযোগিতা করে না। তাই আগাছা বলে প্রকৃতির চাহিদার কারণে গাছের মালিক তাকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়। বিশ^জগতের প্রতিটি অণুকণিকা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। পৃথিবী ও আকাশের প্রতিটি বস্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। জমিতে তার বীজ বপন করার চেষ্টা করলে জমি সবসময় তাকে উদগীরণ করার জন্য তৈরি থাকে। আকাশের দিকে তার শাখা-প্রশাখা বেড়ে উঠতে থাকলে আকাশ তাদের নিচের দিকে ঠেলে দেয়। পরীক্ষার খাতিরে মানুষকে যদি নির্বাচন করার স্বাধীনতা ও কর্মের অবকাশ না দেয়া হতো তাহলে এ অসৎ জাতের গাছটি কোথাও গজিয়ে উঠতে পারত না। কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ আদম সন্তানকে নিজের স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবণতা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ দান করেছেন, তাই যেসব নির্বোধ লোক প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে লড়ে এ গাছ লাগানোর চেষ্টা করে তাদের শক্তি প্রয়োগের ফলে জমি একে সামান্য কিছু জায়গা দিয়েও দেয়, বাতাস ও পানি থেকে সে কিছু না কিছু খাদ্য পেয়েই যায় এবং শূন্যও তার ডালপালা ছড়ানোর জন্য অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু জায়গা তাকে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু যতদিন এ গাছ বেঁচে থাকে ততদিন তিতা, বিস্বাদ ও বিষাক্ত ফল দিতে থাকে এবং অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথেই আকস্মিক ঘটনাবলির এক ধাক্কাই তাকে সমূলে উৎপাটিত করে।

কৃষক ফলজ গাছের বীজ রোপণ করে কিন্তু আগাছার বীজ রোপণ না করার পরও সে অবৈধভাবে ফলজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে জায়গা করে সেও জেগে উঠে। ফলজ গাছকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ভালো ফল দানে সে শুধু বাধাগ্রস্তই করতে পারে। বুদ্ধিমান কৃষক যথাসময়ে নিড়ানীর মাধ্যমে তাকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলে। ফলে ফলজ গাছগুলো স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠে এবং ভালো ফল দান করে।
পৃথিবীর ধর্মীয়, নৈতিক, চিন্তাগত ও তামাদ্দুনিক ইতিহাস অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই কালেমায়ে তাইয়েবা তথা ভালো কথা এবং মন্দ কথার এ পার্থক্য সহজে অনুভব করতে পারে। সে দেখবে ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ভালো কথা একই থেকেছে। কিন্তু মন্দ কথা সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য। ভালো কথাকে কখনো শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলা যায়নি। কিন্তু মন্দ কথার তালিকা হাজারো মৃত কথার নামে ভরে আছে। এমনকি তাদের অনেকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, আজ ইতিহাসের পাতা ছাড়া আর কোথাও তাদের নাম নিশানাও পাওয়া যায় না। স্ব স্ব যুগে যেসব কথার প্রচণ্ড দাপট আজ সেসব কথা উচ্চারিত হলে মানুষ এই ভেবে অবাক হয়ে যায় যে, এমন পর্যায়ের নির্বুদ্ধিতাও মানুষ করেছিল।
তারপর ভালো কথা যখনই যে জাতি বা ব্যক্তি যেখানেই গ্রহণ করে সঠিক অর্থে প্রয়োগ করেছে সেখানেই তার সমগ্র পরিবেশ তার সুবাসে আমোদিত হয়েছে। তার বরকতে শুধু সেই ব্যক্তি বা জাতিই সমৃদ্ধ হয়নি; বরং তার আশপাশের জগতও সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কোনো মন্দ কথা যেখানেই ব্যক্তি বা সমাজজীবনে শিকড় গেড়েছে সেখানেই তার দুর্গন্ধে সমগ্র পরিবেশ পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে এবং তার কাঁটার আঘাত থেকে তার মান্যকারীরা নিরাপদ থাকেনি এবং এমন কোনো ব্যক্তিও নিরাপদ থাকতে পারেনি যে তার মুখোমুখি হয়েছে।

যারা নিজেদের রবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অবিশ্বস্ততা, অবাধ্যতা, স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ, নাফরমানি ও বিদ্রোহাত্মক কর্মপন্থা অবলম্বন করল এবং নবীগণ যে আনুগত্য ও বন্দেগির পথ অবলম্বন করার দাওয়াত নিয়ে আসেন তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করল, তাদের সমগ্র জীবনের কর্মকাণ্ড এবং সারা জীবনের সব আমল শেষ পর্যন্ত এমনি অর্থহীন প্রমাণিত হবে, যেমন একটি মূল্যহীন আগাছা বা এটি একটি ছাইয়ের স্তূপ, দীর্ঘদিন এক জায়গায় জমা হতে হতে তা পাহাড়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাত্র একদিনের ঘূর্ণিঝড়ে তা এমনভাবে উড়ে গেল যে তার প্রত্যেকটি কণা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা তাদের রবের সাথে কুফরি করল তাদের কার্যক্রমের উপমা হচ্ছে এমন ছাইয়ের মতো যাকে একটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনের প্রবল বাতাস উড়িয়ে দিয়েছে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের কোনোই ফল লাভ করতে পারবে না।’ (সূরা ইবরাহিম-১৮)
তাদের চাকচিক্যময় সভ্যতা, বিপুল ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, বিস্ময়কর শিল্প-কলকারখানা, মহাপ্রতাপশালী রাষ্ট্র, বিশালায়তন বিশ^বিদ্যালয়গুলো এবং তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চারুকলা-ভাস্কর্য-স্থাপত্যের বিশাল ভাণ্ডার, এমনকি তাদের ইবাদত-বন্দেগি, বাহ্যিক সৎকার্যাবলি এবং দান ও জনকল্যাণমূলক এমন সব কাজকর্ম যেগুলোর জন্য তারা দুনিয়ায় গর্ব করে বেড়ায়, সব কিছুই শেষ পর্যন্ত ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হবে। কিয়ামতের দিনের ঘূর্ণিঝড়ে ছাইয়ের স্তূপকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং আখিরাতের জীবনে আল্লাহর মিজানে রেখে সামান্যতম ওজন পাওয়ার জন্য তার একটি কণাও তাদের কাছে থাকবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement
৪টি সংস্কার করলেই অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিতে পারবে : মোস্তাফিজার রহমান গৌরনদীর সাবেক মেয়রকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ বাংলাদেশে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করতে চায় পাকিস্তান ডেঙ্গুতে আরো ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ১২১৪ বক্তৃতায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানালেন ড. ইউনূস আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতারি পরোয়ানা আ’লীগের সাবেক এমপি শাহজাহান ওমর কারাগারে কাঁঠালিয়ায় শাহজাহান ওমরের গ্রেফতারে বিএনপির আনন্দ মিছিল ইউক্রেন রাশিয়া ইউকে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া ও ড. ইউনূসের কুশল বিনিময় পারমাণবিক বোমা বিষয়ে ইরানের অসহযোগিতার অভিযোগ পশ্চিমা বিশ্বের, আইএইএ’র ভিন্নমত

সকল