২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাসূল সা:-এর যুগের ব্যাংকব্যবস্থা বনাম আধুনিক ব্যাংকিং

-


গত দিনের পর
ক. মহানবী সা:-এর যুগে ব্যাংকিং
মহানবী সা:-এর আগমনের ফলে ইসলাম পূর্ণতা লাভ করে। তিনি আদর্শিক ক্ষেত্রেই পূর্ণতা আনয়ন করেননি, অর্থনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পূর্ণতার বিধান কায়েম করেন। মহানবী সা:-এর আমলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক প্রসার লাভ করে। তিনি সুদবিহীন অর্থব্যবস্থার ভিত রচনা করেন। মহানবী স: সুদের ভয়াল ক্ষতি থেকে আরব জাতিকে মুক্ত করেন। নবীজী সা:-এর অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিংব্যবস্থা বিভিন্ন যুগপরিক্রমায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। নবীজী সা:-এর আমলে চারটি আমানত ও বিনিয়োগ পদ্ধতি লক্ষ করা যায়।
আমানত গচ্ছিত রাখা : মহানবী সা: ছিলেন আরবের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। লোকেরা তাকে ‘আল-আমিন’ বলে সম্বোধন করত। অমুসলিম-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ তাঁর কাছে প্রচুর ধন-সম্পদ ও অর্থকড়ি জমা রাখত। নবীজী সা: মানুষের আমানত যথাসময়ে ফেরত দিতেন। মদিনায় হিজরত করার সময়ও মহানবী সা: মানুষের আমানত ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ জন্য মহানবী সা: তাঁর চাচাতো ভাই আলি রা:-কে দায়িত্ব প্রদান করেন। আলি রা: আমানতের অর্থ-সম্পদ প্রাপকদের কাছে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

মহানবী সা:-এর আমলে অন্যতম বড় ব্যবসায়ী ছিলেন যুবাইর ইবনে আওয়াম রা:। তিনি খুব বিশ্বাসভাজন সাহাবি ছিলেন। বহু লোক তাঁর কাছে ধন-সম্পদ জমা রাখত। তবে লোকজনের জমা গ্রহণ করার সময় আওয়াম রা: তা আমানত হিসেবে না নিয়ে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতেন। এই অর্থ তিনি ভোগ বা ব্যবহার করতেন এবং তা বিনিয়োগ করার অধিকারও পেতেন। এর কারণ ছিল আমানত হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে জমাকারী তার অধিকার বা ধন-সম্পদ থেকে বঞ্চিত হত। ধীরে ধীরে আওয়াম রা: প্রণীত এই ব্যবস্থা এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, বিভিন্ন লোকেরা তাঁর কাছে বাইশ লাখ দিরহাম জমা রেখেছিল।
নবীজী সা:-এর মুদারাবা ব্যবসা : ব্যাংকব্যবস্থার অন্যতম কাজ হলো ব্যবসায় পুঁজি খাটানো। মহানবী সা:-এর সময়কালে মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালিত হতো। এই ব্যবসায় একজন অর্থ দিত, অন্যজন সেটা দিয়ে ব্যবসা কারবার পরিচালনা করত। ব্যবসায় লাভ হলে তা সম্মতির ভিত্তিতে উভয়ে ভাগ করে নিত। আর লোকসান হলে তা বহন করত পুঁজি সরবরাহকারী। মহানবী সা: তখনো নবুয়ত লাভ করেননি। তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। তখন আরবে এক ধনাঢ্য মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম খাদিজা রা:। মহানবী সা: খাদিজা রা:-এর সাথে মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা করেছেন।
সুদি কারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা : মানবজাতির জন্য কুরআন ও হাদিসে যেসব নির্দেশনা এসেছে, তার মধ্যে সর্বশেষ নির্দেশনা হলো হারাম ঘোষিত সুদ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায় ও সুবিচর কায়েম করার লক্ষ্যে আল-কুরআনে সব ধরনের সুদের লেনদেনকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যবসায় বাণিজ্যে সুদ পরিহার করার নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। তা হলে তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।’ (সূরা আলে-ইমরান : ১৩০) কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন, ‘তারা (কাফেররা) বলে বেচাকেনা তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা আল-বাকারা : ২৭৫)

উল্লেখ্য, জাহিলি যুগে সুদের রমরমা ব্যবসা ছিল। তখন নবীজী সা:-এর চাচা আব্বাস রা: সুদের কারবার করতেন। বহু লোকের কাছে তাঁর হাজার হাজার দিরহাম সুদের অর্থ বাকি ছিল। ৬৩০ সালে বিদায় হজের সময় আল্লাহর রাসূল সা: তাঁর ভাষণে তাঁর গোত্রের মহাজনদের সুদের দাবি বাতিল বলে ঘোষণা করেন। তিনি সর্বপ্রথম তাঁর চাচা আব্বাস রা:-এর সুদের দাবি বাতিল ঘোষণা করেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘জাহিলি যুগের সব সুদ বাতিল করা হলো। সর্বপ্রথম স্বগোত্রীয় মহাজনদের সুদ (আমার চাচা) আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করলাম।’ (সহিহ মুসলিম) মহানবী সা: সুদ রহিত করে বিধান জারি করার পর সাহাবিরা তা মেনে চলেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। বরং সুদ রহিত হওয়ার পর মানুষ হাজার বছরের সুদি কারবারের শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করে। সমাজে ফিরে আসে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।
বায়তুলমাল সৃষ্টি : ইসলামী যুগের সবচেয়ে পুরাতন সুসংগঠিত ব্যাংকিং বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো বায়তুলমাল। মহানবী সা: মদিনায় হিজরতের পর মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। ইসলামের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধান তিনি প্রবর্তন করেন। তিনি প্রথম বায়তুলমাল বা রাজস্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। জনগণের সাহায্য, দান, জাকাত, কর ইত্যাদি বায়তুলমালে জমা হতো। এখান থেকেই চাহিদামাফিক অর্থ বা দ্রব্য নিয়ে অসহায় মানুষের জন্য ব্যয় করা হতো।

খ. খোলাফায়ে রাশেদার যুগে ব্যাংকিং
খোলাফায়ে রাশেদার যুগে ব্যাংকিং ছিল বায়তুলমালভিত্তিক ও সুদমুক্ত। মহানবী সা: মদিনা রাষ্ট্রে বায়তুমালভিত্তিক যে আর্থিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছিলেন, খোলাফায়ে রাশেদার আমলে তা আরো সংগঠিত রূপ লাভ করে। দ্বিতীয় খলিফা উমর রা: বায়তুলমালকে একটি আধুনিক অবয়বে গড়ে তোলেন। তিনি বায়তুলমালের উৎসগুলোকে সুনির্দিষ্ট রূপ দান করেন। বায়তুলমাল বা রাজস্বের উৎসগুলো ছিল জাকাত (সম্পদের ওপর ধার্য), খারাজ (ভূমির কর), জিজিয়া (পোল ট্যাক্স), কাস্টমস ডিউটি, টোল এবং সাদাকাহ বা দান। মালিকানাবিহীন সম্পদ, স্বধর্মত্যাগী ব্যক্তির সম্পদ এবং উত্তরাধিকারহীন মৃত ব্যক্তির সম্পদও বায়তুলমালের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বায়তুলমালের সম্পদ ব্যয়ের বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা দান করেন উমর রা:। এই সম্পদ রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ব্যয় করা হতো। এর মধ্যে সামরিক ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, জনসাধারণের কল্যাণমূলক ব্যয়, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং ছাত্রবৃত্তি ইত্যাদি বায়তুলমাল থেকে ব্যয় করা হতো। তখন আধুনিকালের মতো চেক বা প্রত্যয়পত্র না থাকলেও অনেকটা এর মতোই লেনদেন হতো। সাহাবি আব্বাস রা: মদিনায় দিরহাম গ্রহণ করে তা কুফায় ভাঙানোর স্বীকারপত্র লিখে দিতেন। এভাবে যুবাইর রা:-এর পুত্র আবদুল্লাহ রা: মক্কায় দিরহাম গ্রহণ করে তা ইরাকে ভাঙানোর স্বীকারপত্র লিখে দিতেন। আবদুল্লাহ রা:-এর ভাই মুস’আব ইরাকে সেই স্বীকারপত্র ভাঙিয়ে নগদ অর্থ প্রদান করতেন। এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধীরে ধীরে আরো বিস্তার লাভ করে।
(চলবে)

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement