১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জমাদিউল আউয়াল মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ঘটনাবলির জন্ম

-

চন্দ্র মাসের পঞ্চম মাস জমাদিউল আউয়াল আউয়াল মাস ১৯ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ নভেম্বর ২০২৪ সালে (সোমবার) থেকে ১৪৪৬ হিজরি সনের পবিত্র জমাদিউল আউয়াল মাস গণনা শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড শীতে কিংবা প্রবল শৈত্যপ্রবাহে সব কিছু প্রায় জমে জমে যায়। তাই এ মাসের এই নাম। এই মাসটিতে আরবে ঠাণ্ডা নেমে আসত। প্রসিদ্ধ উষ্ট্রযুদ্ধও এই মাসের ১৫ তারিখে সংঘটিত হয়। আর দুটি মাস হলো ‘জমাদিউস সানি’, এটি হিজরি আরবি সনের ষষ্ঠ মাস। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এই মাস দু’টি ‘জমাদিউল আউয়াল’ ও ‘জমাদিউস সানি’ নামে সমধিক পরিচিত। এর বাংলা অর্থ হলো প্রথম জমাদা ও দ্বিতীয় জমাদা বা প্রথম শীত ও দ্বিতীয় শীত; অর্থাৎ শীতকালের প্রথম মাস ও শীতকালের দ্বিতীয় মাস। (আল মুনজিদ) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘তুমি পর্বতমালা দেখছ, মনে করছ তা স্থির অচল, অথচ তারা মেঘপুঞ্জের ন্যায় সঞ্চারমান। এটি আল্লাহরই সৃষ্টি নৈপুণ্য, যিনি সব কিছুকে করেছেন সুষম। তোমরা যা করো সে সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত।’ (সূরা-২৭ নমল, আয়াত-৮৮) আর জুমাদা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো স্থির, অবিচল, দৃঢ়, কঠিন; জমাটবদ্ধ, নিস্তব্ধ, নীরব, নিথর, শুষ্ক, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত; শীতল, শীতকাল, শীতবস্ত্র; কার্পণ্য, বদ্ধমুষ্টি; কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অস্থির সময়, চিন্তাযুক্ত অবস্থা। যেহেতু আরব দেশে শীতকালে প্রচণ্ড শীতে তরল পানি জমে কঠিন বরফে পরিণত হতো; জড় পদার্থগুলো জমে শক্ত হয়ে যেত; উদ্ভিদ ও জীব নিথর হয়ে থাকত; প্রাণীরা নীরব হয়ে যেত; তাই এ মাসের এই নামকরণ করা হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, ‘জুমাদা’ হলো আরবদের শীতকাল। এটি বসন্তের নিকটবর্তী; গ্রীষ্মের পূর্বে। কারণ দুই ভূমির সীমানা বা দুই বাড়ির সীমানাকে এবং নিকট প্রতিবেশীকেও ‘জুমাদা’ বলা হয়। একত্রে এ দুই মাসকে ‘জুমাদায়ান’ বা ‘জুমাদায়িন’ বলা হয়। মূলত এই মাসের নামের মাঝে যেসব অর্থ বিদ্যমান, তা তিন ভাগে বিভাজনযোগ্য। যথা ইতিবাচক অর্থ, নেতিবাচক অর্থ ও মধ্যবর্তী বা ক্রান্তিকালীন অর্থ। সুতরাং আমাদের করণীয় হবে ইতিবাচক অর্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো বেশি বেশি নেককাজ বা সৎকর্ম সম্পাদনে ব্রতী হওয়া। নেতিবাচক অর্থগুলো অনুধাবন করে নিজের মধ্যে থাকা সব নেতিবাচক অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রতি মনোনিবেশ করা। আর আরবি অন্যান্য মাসের মতো এই মাসেরও রয়েছে কিছু তাৎপর্য। এই মাসের আমল হলো নফল নামাজ, নফল রোজা, দান-খয়রাত ইত্যাদি। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নফল নামাজ, তথা তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, জাওয়াল ও আউয়াবিন নামাজ আদায় করা। কাজা রোজা থাকলে পুরা করা, মান্নত রোজা থাকলে তা আদায় করা। মাসের চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে ‘আইয়ামে বিজ’ বা শুভ্র সময়ের বাবা হজরত আদম আ:-এর সুন্নত রোজা রাখা। সপ্তাহে প্রতি সোমবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার নফল রোজা রাখা। বিশেষত ‘রজব’ মাসের প্রস্তুতি হিসেবে আরো বেশি নেক আমল এবং অধিক পরিমাণে নফল নামাজ ও নফল রোজা করার কথা রয়েছে। জিকির-আজকার, দোয়া-কালাম, দরুদ ও সালাম, তাসবিহ-তাহলিল, তাওবা-ইস্তিগফার, খতম তিলাওয়াত, সদকা-খয়রাত ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে মাস অতিবাহিত করলে নিশ্চিত এর বরকত, ফজিলত ও কল্যাণ লাভ হবে। অন্যথায় সময়ের অপচয়ের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে হবে।
আলেমদের আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন : ১৪২৫ হিজরির ২৪ জুমাদাল উলা আলেমদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স ঘটিত হয়। এটি বিভিন্ন দেশের শীর্ষ আলেমদের একটি সংগঠন, যা আল্লামা ইউসুফ কারজাভি রহ.-এর আহ্বানে গঠন করা হয়।
সুলতান মুরাদ খান তৃতীয়র জন্মগ্রহণ
৯৫৩ হিজরির ৫ জুমাদাল উলা মোতাবেক ১৫৪৬ সালের ৪ জুলাই উসমানীয় সাম্রাজ্যের দ্বাদশ সুলতান মুরাদ খান তৃতীয় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান, যিনি ১৫৭৪ সাল থেকে ১৫৯৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন। ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের সাথে সুলতান তৃতীয় মুরাদ মিত্রতা বজায় রেখেছিলেন। তিনি নুরবানু সুলতান ও শাহজাদা সেলিমের বড় পুত্র।
জনপ্রিয় কবি ইবনে রুমির মৃত্যুবরণ : ২৮ জুমাদাল উলা ২৮৩ হিজরি মোতাবেক ১৩ জুলাই ৮৯৬ সাল ইবনে রুমি নামে পরিচিত মহান কবি ‘আবি আল-হাসান আলী ইবনে আল-আব্বাস ইবনে জুরাইজ’-এর মৃত্যু হয়। ৮৩৬ সালে ইবনে রুমি তৎকালীন আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন।
তিউনিসিয়া লিবিয়া চুক্তি স্বাক্ষর : ৩ জুমাদাল উলা ১৪০২ হিজরি মোতাবেক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ সালে তিউনিসিয়া ও লিবিয়া পরস্পর সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
রাশিয়ার কুল আল শরিফ মসজিদ উদ্বোধন : ১৮ জুমাদাল উলা ১৪২৬ হিজরি মোতাবেক ২৫ জুন, ২০০৫ সালে রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রের তাতারস্তানের রাজধানী কাজান শহরে ‘কুল আল-শরিফ’ মসজিদের উদ্বোধন।
এটি তৈরি করতে ১০ বছর সময় লেগেছিল। এতে রয়েছে ইসলামের ইতিহাস এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপির একটি জাদুঘর। এটি ইউরোপের বৃহত্তম মসজিদ। দুই তলাবিশিষ্ট মধ্যযুগে নির্মিত এই মসজিদের প্রথম তলায় নামাজ ও ইবাদত-বন্দেগি করা হয় এবং দ্বিতীয় তলায় একটি ইসলামী মিউজিয়াম রয়েছে। রাশিয়ায় এটি মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শনের একটি।
মুসলমানদের জাফা পুনরুদ্ধার : ২ জুমাদাল উলা ৬৬৬ হিজরি। আল-জাহির বেবারদের নেতৃত্বে মুসলিমরা ক্রুসেডারদের কাছ থেকে জাফা শহরটি পুনরুদ্ধার করে। বর্তমান যুগেও এটি ইসরাইলের আরব অধ্যুষিত শহর। এখনো পর্যন্ত জাফা এলাকাটি তেলআবিব শহরের সবচেয়ে পুরোনো অংশ। তেলআবিব একটি জনপদ হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি পায় ১৯২১ সালে। তখনো এটি জাফা পৌর শহরের অধীনে ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৪ সালে এটি একটি আলাদা শহরে পরিণত হয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের ফিলিস্তিন যুদ্ধে তেল আবিব শহরের মধ্যে বহু এলাকা নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫০ সালের জাফা শহরকেও তেলআবিবের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে এই শহরের নাম রাখা হয় ‘তেলআবিব-ইয়াফো’। বর্তমানে এই শহরের আয়তন ৫২ বর্গকিলোমিটার। প্রায় চার লাখ ৬০ হাজার মানুষ শহরে বাস করে। বর্তমানে এটি ইসরাইলের সবচেয়ে জনবহুল শহর।
পরিশেষে এই জন্য আমাদেরকে সব ধরনের শিরক, কুফর ও বিদয়াত থেকে মুক্ত হয়ে ঈমানের ওপর অটল থাকতে হবে। তাই আসুন আমরা শিরকমুক্ত ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারি আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি


আরো সংবাদ



premium cement