৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মুসলিম উম্মাহর সর্বজনীন অর্থব্যবস্থা

-

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো অর্থনীতি। সমাজে বহু অর্থব্যবস্থা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল, জনকল্যাণকর, বৈজ্ঞানিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা হলো ইসলামী অর্থব্যবস্থা। সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, ইসলামী অর্থনীতি হলো জনসাধারণের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান। ‘আল্ল­াহর বিশ্ব-প্রতিপালন নীতির অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের জন্য সমুদয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক এবং কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাই ইসলামী অর্থনীতি। সৃষ্টজীবের কল্যাণের জন্য সম্পদের সর্বাধিক উৎপাদন, সুষ্ঠু বণ্টন, ন্যায়সঙ্গত ভোগবণ্টনই হলো ইসলামী অর্থনীতি।’ ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তির নয়; বরং সম্পদের মালিক একমাত্র আল্ল­াহ। মানুষ সম্পদের আমানতদার, মালিক নয়। শ্রমের ভিত্তিতে মানুষ সম্পদের অধিকার লাভ করবে। আর পঙ্গু, বৃদ্ধ, কর্মে অক্ষমদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তার জন্য জাকাত বা অন্য ব্যবস্থা করা হয়। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ অভাবগ্রস্তদের অভাব পূরণে প্রস্তুত রাখে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সুষম বণ্টন জনকল্যাণমুখী টেকসই অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠা করে। যার উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদিস। রাসূল সা: মদিনায় আর্থিক সমৃদ্ধির নজির স্থাপন করেন। শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্বে ইসলামী অর্থব্যবস্থা ধুলোয় মলিন হয়ে গেছে। মুসলিম উম্মাহর উচিত, মানবতার কল্যাণে সমাজে ইসলামী অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা, যাতে করে মানুষ পরাধীন ও যন্ত্রমানব হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।
ইসলামী অর্থব্যবস্থা ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প আর কৃষিকে উৎসাহিত করে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় জাকাত অন্যতম চালিকাশক্তি। আল্লাহ তায়ালা জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। জাকাত আদায়কারী ও গ্রহীতা উভয়ের কল্যাণ রয়েছে। ইসলামী সমাজে বিত্তবান লোকেরা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হতে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে জাকাত আদায় করে এবং গ্রহীতারা নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দোয়া করো, নিশ্চয় তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা তাওবাহ আয়াত-১০৩) এ ছাড়াও ফিতরা, দান, সাদাকা, কাফফারা বিধান এবং উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনের বিধান রয়েছে। আর সবসময় হালাল-হারামের বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে সমৃদ্ধি অর্জনের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় যেকোনো মূল্যে মুনাফা অর্জন চাই যেমন- চোরাচালান, ভেজাল মেশানো, মজুদদারি, ওজনে কারচুপি, মুনাফাখোরি, অন্যায় জবরদখল। মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান কমানোর জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিকল্প নেই।
আর্থিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী অর্থব্যবস্থা : প্রচলিত অর্থব্যবস্থা অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা, লাগামহীন চিন্তার স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের নামে বুর্জোয়া শ্রেণীর শাসন আবার কোনোটিতে ব্যক্তিস্বাধীনতা উচ্ছেদ, চিন্তার পরাধীনতা, সর্বহারার নামে একদলীয় শাসন। আর মুনাফা অর্জনের আশায় মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর মদ, গাঁজা, আফিম, হেরোইন, ইয়াবা ইত্যাদি উৎপাদন এবং উৎসাহিত করে থাকে। সেই অর্থব্যবস্থায় সুবিচার আর সর্বজনীন মানবকল্যাণ আশা করা যায় না। অপর দিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও সুষম বণ্টন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সম্পদের একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা নয়; বরং সব শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা হয়। মানবকল্যাণকর দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। আর অস্বাস্থ্যকর দ্রব্য উৎপাদন ও আমদানি-রফতানি নিষিদ্ধ করে ইসলামী অর্থনীতি। আর অর্থ কুক্ষিগত না রেখে, আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করা এবং সবার মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর যারা সোনা ও রুপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা তাওবাহ, আয়াত-৩৪)
উদারতা ও নৈতিকতাবোধ প্রতিষ্ঠায় ইসলামী অর্থব্যবস্থা : প্রচলিত অর্থব্যবস্থা সুদভিত্তিক হওয়ায়, সমাজে সম্পদের বৈষম্য তৈরি হয়। অধিক মুনাফা লাভের আশায় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান করে না; বরং কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়রানি ও জুলুমের শিকার হয় শ্রমজীবী মানুষ। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। সেখানে প্রত্যেকেই আত্মকেন্দ্রিক। আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি, মায়া, উদারতা ও নৈতিক দায়িত্ব বিন্দুমাত্র নেই। অথচ খাওদাও ফুর্তি করো স্লোগান দিয়ে অর্থের অপচয় করা হয়। আর অভাবগ্রস্ত মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই সমাজে অশান্তি লেগেই আছে। অন্য দিকে সম্পদ নির্ধারিত পথে ব্যয়ের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে উদারতা ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকেও। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাঈল আয়াত : ২৬-২৭)
সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ইসলামী অর্থব্যবস্থা : চর্মচোখে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত অর্থব্যবস্থা মানুষকে মুক্তি দিয়েছে; কিন্তু না, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালে বোঝা যায়, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে পরাধীন, যান্ত্রিক, স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলেছে। আর ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সুষম বণ্টন, মানবকল্যাণ ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক মডেল প্রতিষ্ঠা করে, যার উৎস পবিত্র কুরআন ও হাদিস। সমাজে সাম্য ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সব শ্রেণীর মানুষের হক, অধিকার ও দায়িত্বের সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে কুরআন ও হাদিসে। সর্বাধিক মুনাফা অর্জন নয় বা সম্পদ কুক্ষিগত করা নয় সর্বজনীন মানবকল্যাণ ইসলামী অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য। এই অর্থব্যবস্থা পারস্পরিক সহযোগিতা, স্বাচ্ছন্দ্য ও নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে সাহায্য করে। পারস্পরিক সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি করে অভাব মোচনের জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থা উৎসাহিত করে। তারই ফলশ্রুতিতে মদিনায় ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর যদি সে অসচ্ছল হয়, তাহলে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে। আর সাদাকা করে দেয়া তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৮০)
কর্জে হাসানা প্রতিষ্ঠায় ইসলামী অর্থব্যবস্থা : বর্তমান সমাজে ঋণ একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার মাধ্যম। একসময় ঋণকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী মানুষকে খারাপ চোখে দেখা হলেও, এখন সয়ে গেছে। ব্যবসার ভাবনা নিয়ে ঋণ প্রদান সমাজে সম্পদের বৈষম্য তৈরি করে। সুদের ভয়াল থাবায় বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। আবার ঋণের বোঝায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে বিনিময়হীন উত্তম ঋণ যা ইসলামী অর্থব্যবস্থায় কর্জে হাসানা হিসেবে পরিচিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, ফলে তিনি তার জন্য বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন? আর আল্লাহ সঙ্কীর্ণ করেন ও প্রসারিত করেন এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফেরানো হবে।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৪৫) বিনিময়ের মানসিকতা পরিহার করে সহযোগিতার মনোবৃত্তি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপকভাবে ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানা বিলোপে ইসলামী অর্থব্যবস্থা : প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও ব্যক্তিমালিকানা চুম্বকের বিপরীত আকর্ষণের মতো। তাই সর্বজনীন কল্যাণ কল্পনা করা যায় না। আর ইসলামী অর্থব্যবস্থা রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি মালিকানার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মানবকল্যাণ ও সর্বজনীন অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত করে। কেননা, সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহর জন্যই যা রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা রয়েছে জমিনে। আর তোমরা যদি প্রকাশ করো যা তোমাদের অন্তরে রয়েছে অথবা গোপন করো, আল্লাহ সে বিষয়ে তোমাদের হিসাব নেবেন।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৮৪)
প্রচলিত অর্থব্যবস্থা আমাদের সমাজজীবনকে বিষিয়ে তুলছে। সম্পদের প্রতিযোগিতা বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডিজিটাল প্রতারণা, রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ, মিডিয়ায় গুজব, সুবিচার নির্বাসনে, ব্যাপক সুদের প্রচলন, ইচ্ছার লাগামহীন স্বাধীনতা, অর্থের মাপকাঠিতে আত্মীয় সম্পর্ক, কর্মচারীদের সাথে অসদাচরণ, শিক্ষাব্যবস্থায় যৌনাচার, নারীরা ভোগ্যপণ্যসহ সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে অশান্তির কালো ছায়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ, সদাচার ও নিকট আত্মীয়দের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিষেধ করেন।’ (সূরা নাহল, আয়াত-৯০) মুসলিম উম্মাহ স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া সুবিশাল সাম্রাজ্যে শোষণমুক্ত মানবকল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সামান্য সময় নয়, বরং হাজার বছর ধরে দাপটের সাথে বিশ্ব অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে, যা সমকালীন বিশ্বের বিস্ময়। তাই বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জীবনযাপনের জন্য ইসলামী অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement