৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ঈমানের থার্মোমিটার

-

রাব্বুল ইজ্জত মানুষকে সব সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, সম্মানিত করেছেন। আর নবী-রাসূলদের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। নবী-রাসূল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির কাছে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন যেন মানব জাতি একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি, যাতে (সে তাদের বলে যে) তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত বা বাতিলকে বর্জন করো।’ (সূরা-নাহল-৩৬)
কোনো মানুষ সাধনা করে নবী-রাসূল হতে পারবে না, কেননা নবী-রাসূলগণ আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন। আমরা নিজেদের সম্মানকে যতটা না বুকে লালন করি এর চেয়ে কোটি গুণ বেশি লালন করি আম্বিয়া কেরামের প্রতি সম্মানবোধ ও মুহাব্বাত।
আর এ মুহাব্বাতের কাঠি আমাদের ঈমানের পারদ মাপার কাঠি, বলা চলে এ মুহাব্বাতটুকুই ঈমানের থার্মোমিটার।
আল্লাহ বলেন- নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়ে ঘনিষ্ঠতর এবং কাছের। আর তাঁর স্ত্রীরা তাদের মা-জননী।’ (সূরা আহজাব-০৬)
নবী সা:-এর হক আমাদের নিজেদের জীবনের চেয়ে বেশি, আর তাঁর সম্মানিতা স্ত্রীগণ সব মুসলমানের মা জননী, তাঁরা আমাদের রূহানি মা; আর এ মায়েদের হক আমাদের জিসমানি মায়েদের চেয়ে অধিক। যেমন রূহের অধিকার শরীরের অধিকারের চেয়ে বেশি।
সুতরাং, নবী এবং নবী পরিবারের প্রতি বিন্দুমাত্র কটূক্তি একজন মুমিনের হৃদয়ে গভীর জখম তৈরি করবে এটিই স্বাভাবিক আর কটূক্তিকারীদের প্রতি আসমানি লানত বর্ষিত হবে তা চির সত্য।
আল্লাহ বলেন-‘যারা আল্লাহ ও রাসূলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তো তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আহজাব-৫৭) পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই, পার্থক্য গড়ে দেয়ার সেই দিন- ১৭ রমজান, দ্বিতীয় হিজরি, বদর যুদ্ধের বিশিষ্ট দিনটির কথা। মানুষ ও ফেরেশতার সম্মিলিত বাহিনীর এই যুদ্ধে আবু জাহেলের নরকযাত্রার সফর ও বেইজ্জতির শুরু। সেদিন আবু জাহেল কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ছিল, যাকে পাহারারত ছিল ঝানু ঝানু তরবারিধারী ও বর্শাধারী। এই নিরাপত্তাব্যুহ ভেদ করে তার পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া ছিল রীতিমতো অসম্ভব।
এ সময় আব্দুর রহমান ইবনু আওফ রা:-এর পাশে হঠাৎ দুজন অল্প বয়সী যুবক এসে দাঁড়িয়ে কিছু সময় পর তাদের একজন অপরজন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে জিজ্ঞেস করে-
‘চাচা, আবু জাহল কোনটা?’
আব্দুর রহমান ইবনু আওফ রা: আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
‘তুমি জেনে কী করবে?’
তাদের একজন বলল, ‘শুনেছি সে নাকি নবীজী সা:-কে গালি দেয়, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, ওকে দেখামাত্র হয় আমি তাকে শেষ করব আর নয়তো সে আমাকে।
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ দুজনকেই দেখিয়ে দিলেন আবু জাহেলের অবস্থান, দেখামাত্রই দুজনই শাঁ করে সমস্ত ঝানু ঝানু সেনা এবং নিরাপত্তাবেষ্টনী পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন আবু জাহেলের কাছে, মুহূর্তেই তরবারির আঘাতে আবু জাহেলের অপবিত্র শরীরটা ক্ষতবিক্ষত ঝাঁঝরা করে দিলো, তারা দুজন ছিলেন মুআজ এবং মুআওয়িজ রা:। প্রচণ্ড খুশিতে অতি দ্রুত রাসূল সা:-এর কাছে হাজির হয়ে দু’জনই আবু জাহেলের হত্যাকারী বলে দাবি করেন। নবীজী দুজনের তরবারি পরীক্ষা করে দুজনকেই জানান : ‘তোমরা দুজনেই তাকে হত্যা করেছ।’ (বুখারি-৩১৪১, মুসলিম-১৭৫২)
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কটূক্তিকারীকে নরকযাত্রায় পাঠানোর জন্যই লেগে গিয়েছিল দু’টি তাজা কলবধারীর দুর্দণ্ডপ্রতাপে প্রতিযোগিতা,আল্লাহু আকবার। রক্তাক্ত আবু জাহেলের ধুলায় লুটোপুটি খাওয়ার চরম লাঞ্ছনাদায়ক এই দৃশ্য চোখে পড়ে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:-এর, তিনি এই জাহেলকে সম্পূর্ণ শেষ করে দেন। নির্লজ্জ আবু জাহেল মৃত্যুর আগে বলল- আফসোস কৃষকের ছেলেরা ছাড়া অন্য কেউ যদি আমাকে হত্যা করত?
এরপর নবীজি আবু জাহেলের দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘এই লোক ছিল এই উম্মাহর ফেরাউন।’
(বুখারি-৩৯৬২)
রাসূল সা: আরো বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন, তাঁর বান্দাদের সাহায্য করেছেন। আর একাই পরাজিত করেছেন শত্রু সেনাদের, বিজয় তো আল্লহরই হয়।’ আর যে হিদায়াত পাওয়ার পর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ।’ (সূরা নিসা-১১৫)
নবী অবমাননাকারীর শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড। এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. উল্লেখ করেন, সব মাজহাবের ঐকমত্যে সিদ্ধান্ত হলো- নবী সা:-এর অবমাননাকারী কাফির এবং তার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড।
সেই ১৪০০ বছর পর এখন চলছে ১৪৪৬ হিজরি। প্রিয় রাসূল সা:-এর প্রতি কটূক্তিকারী দিয়ে পৃথিবীর পেট পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ মুআজ ও মুআওয়িজের উত্তরসূরি যুবকরা আচ্ছন্ন অনলাইন, মিডিয়া আর নীল জগৎ নিয়ে। মধ্যবয়সীরা দুনিয়ার আকাক্সক্ষায় মত্ত, বৃদ্ধরা লা-জওয়াব।
যেন ঘুমন্ত এক পৃথিবীতে বসবাস আমাদের। মুআজ এবং মুআওয়িজ রা:-এর উত্তরসূরিরা কোথায়?
গান-বাজনা, রিলস, পর্নোগ্রাফিতে যৌবন খুইয়ে যাচ্ছে, মস্তিষ্কের নার্ভ সিস্টেম অকার্যকর ঠেকছে যুব সম্প্রদায়ের কাছে।
এ কারণে নবী অবমাননায় তাদের ব্রেইনের টেনশন সেল ডিয়েক্টিভেট তথা সম্পূর্ণ নিঝুম। যে পৃথিবীতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এর নবীকে অবমাননাকারী বুক ফুলিয়ে বাঁচে, সেই একই পৃথিবীতে মুসলিম হিসেবে আমার বেঁচে থাকার কি মূল্য? ওয়াল্লাহি, এই বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।
একজন মুসলমানের কাছে রাসূল সা: নিজের প্রাণের চেয়ে, নিজের সন্তানের চেয়ে, নিজের মা-বাবার চেয়ে এবং তার যাবতীয় সম্পদ থেকে প্রিয়। যদি কোনো ব্যক্তির এমন মোহাব্বত না থাকে, তাহলে লোকটি প্রকৃত মুসলমানই নয়। রাসূল সা: হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘হজরত আনাস রা: বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার মা-বাবা এবং তার সন্তান ও সব মানুষ থেকে আমাকে বেশি মোহাব্বত করবে। (বুখারি-১৫, মুসলিম-১৭৭)
খোদাদ্রোহীদের রাসূল-অবমাননার ঘটনা নতুন নয়, তাদের পরিণতিও কারো অজানা নয়। স্বয়ং নবী সা:-এর যুগেও রিসালাত-অবমাননার ঘটনা ঘটেছে এবং নবীপ্রেমিক সাহাবিরা তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। নবীর মুহাববাত মুমিনের দ্বীন ও ঈমানের অংশ এবং রাসূল সা: ঈমানদারের জীবন ও কর্মের আদর্শ।
নবী সা:-এর মুহাব্বাত ও ভালোবাসা কেবল আবেগের বিষয় নয়, দ্বীন ও ঈমানের বিষয়। কুরআন মাজিদের বিভিন্ন জায়গায় এ কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের ছেলে, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং ওই সম্পদ, যা তোমরা উপার্জন করো এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য যার ক্ষতির আশঙ্কা তোমরা করো এবং ওই ঘরবাড়ি, যাতে তোমরা বসবাস করো, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে, তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সূরা তাওবা-২৪)
আল্লাহ সুবহানাহু আমাদের হৃদয়কে রাসূল সা:-এর মুহাব্বতে পরিপূর্ণ করে দিন, আমাদের মুআজ এবং মুআওয়িজের উত্তরসূরি প্রজন্ম দান করুন, হাউজে কাউসারের সুমিষ্ট পানি দ্বারা আমাদের আজন্মের পিপাসা পূরণ করে দিন-আমিন।


আরো সংবাদ



premium cement