ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা:-এর আদর্শ
- মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া
- ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০৫
পৃথিবীতে মানব সভ্যতার পরিবর্তনের জন্য অনেক আইন ও মতবাদ রচিত হলেও কেউ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। অথচ মানবতার মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন গোটা মানবজাতির জন্য রহমত। মুসলিম উম্মাহর জীবন পরিচালনার একমাত্র আদর্শ। কারণ নবীজি সা:-কে অনুসরণের মধ্যেই মানবতার কল্যাণ নিহিত। দুনিয়াব্যাপী আজ শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য কত হাহাকার। অথচ চৌদ্দ শ’ বছর আগে বিশ্বনবী সা: গোটা দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করে বুঝিয়ে গেছেন কুরআন-হাদিসের অনুসরণই দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালীন মুক্তির গ্যারান্টি দিতে পারে।
ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতা : যার যা হক ও প্রাপ্য তাকে তা যথাযথভাবে দেয়াকে ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা বলা হয়। আর তার চেয়ে কম করা হলো জুলুম বা অবিচার। ইসলামে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের গুরুত্ব এত বেশি যে, অমুসলিমদের সাথেও তা রক্ষা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। জুলুম ও অবিচারকে হারাম করা হয়েছে। সমাধান বা ফয়সালার ক্ষেত্রে নিজের বা অন্যের মধ্যে ব্যবধান তথা পক্ষপাতিত্ব করার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইনসাফ করতে হবে, যদিও তা আপনজনের বিরুদ্ধে চলে যায়।
মদিনা সনদ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : রাসূলুল্লাহ সা: মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের পর প্রথমেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেখানেই তিনি মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করে দিতেন। তিনি সেখানে ইহুদি-খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে পরিচিত এবং পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। ওই সনদের মাধ্যমে মদিনায় তিনি একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। মহানবী সা: সে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং পদাধিকার বলে তিনি ছিলেন মদিনার সর্বোচ্চ বিচারপতি। এভাবে নবী করিম সা: পরিপূর্ণ শাসক ও বিচারক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই সাথে তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধান বিচারপতি। মহানবী সা: ইসলামী বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করে গেছেন। ইসলামী বিচারব্যবস্থাই একমাত্র কল্যাণকর ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা। শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি এবং অপরাধমুক্ত সমাজগঠনের জন্য এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অপরিহার্য। মহানবী সা: বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তৎকালীন জাহেলি সমাজ পরিবর্তন করে সুশীল ও অপরাধমুক্ত সমাজ উপহার দেন। এ ধারা অব্যাহত থাকে খিলাফতে রাশিদার যুগ পর্যন্ত। বর্তমান মানবসভ্যতায় রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- নাগরিক অধিকার ও তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করা। আর এ অধিকার এবং কর্তব্য পালনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব ও অস্তিত্ব অপরিহার্য। তাই আধুনিক সমাজব্যবস্থায় ন্যায়নীতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইসলামী বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
নবুওয়াতি ধারাবাহিকতার সর্বশেষ মিশন রাসূলে আরাবি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর হাতে পূর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল- জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। তিনি সম্যক উপলব্ধি করেন, ন্যায়বিচার এমন এক প্রচলিত নীতি যার প্রয়োগ সুস্থ সমাজ সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, নবুওয়ত লাভের পর ২৩ বছর প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। তার উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থা মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে সবদিক দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকাশক্তি। পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী মহান আল্লাহ সব নবী ও রাসূলকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের বিধান এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। (সূরা হাদিদ, আয়াত-২৫)
জীবনের সবক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফের গুরুত্ব অপরিহার্য। কারণ ন্যায়বিচার ছাড়া মানবজীবনের কোনো ক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। মানবিক মর্যাদাবোধ ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ এ গুণের কারণেই সৃষ্টি হয়। নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সমাজের অপরাপর সদস্যদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা জরুরি, যেন কারো প্রতি জুলুম না হয়। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে বারবার স্পষ্টভাষায় নবী রাসূলুল্লাহ সা:-কে ন্যায় ইনসাফ কায়েমের নির্দেশনা দেন।
‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দেন।’ (সূরা নাহল, আয়াত-৯০)
‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্য ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদিগকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, তা তাকওয়ার নিকটতর।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত-৮)
‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকাজ পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৫৮)
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন, আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচাল কথা বলো অথবা পাশ কাটিয়ে যাও তবে তোমরা যা করো আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত-১৩৫)
ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সমাজের বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অন্তরে আশা সঞ্চার হয়। কারণ ইনসাফবিহীন কোনো সমাজ কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। সে জন্য মহানবী সা: সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ছিলেন বদ্ধপরিকর।
স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব পরিহার : ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূল সা: কখনো স্বগোত্রীয় মানুষের পক্ষপাতিত্ব কিংবা স্বজনপ্রীতি দেখাননি; বরং প্রতিটি মুহূর্ত নিজের কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে সাহাবিদের মধ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- মাখজুম গোত্রের এক চোর নারীর ঘটনা কুরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল- এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা:-এর সাথে কে আলাপ করতে পারে? তারা বলল, একমাত্র রাসূল সা:-এর প্রিয়তম ওসামা বিন জায়েদ রা: এ ব্যাপারে সুপারিশ করার সাহস করতে পারেন।
সবাই মিলে সুপারিশের জন্য ওসামা রা:-কে ঠিক করলেন। ওসামা নবী সা:-এর সাথে কথা বললেন। নবী সা: বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?’ অতঃপর নবী সা: দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, ‘তোমাদের আগের জাতি এ কাজই ধ্বংস করেছে যে যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট অভিজাত লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর দণ্ড জারি করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদ সা:-এর কন্যা ফাতিমাও চুরি করত; তাহলে আমি তাঁর অবশ্যই (দণ্ডবিধি অনুসারে) হাত কেটে দিতাম।’ (বুখারি-৩৪৭) অমুসলিমদের মধ্যে ন্যায়বিচার : ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা অমুসলিমদের মধ্যেও সমানতালে বাস্তবায়ন করেছেন প্রিয় নবী সা:। এ ক্ষেত্রে নিজের প্রিয় সাহাবি আর অন্যজন ইহুদি হওয়ার কারণে বিন্দুমাত্র টলে যাননি; বরং আপন নীতি অনুযায়ী উভয়ের মধ্যে ফয়সালা করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুসলিমের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে, তাহলে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন।’ (বুখারি-২৪১৬)
ইনসাফকারীদের জন্য সম্মানের আসন : রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, কিয়ামতের কঠিন দিবসে ইনসাফের প্রতিদান কী হবে? তাদের সেই অনন্য প্রতিদান স্মরণ করিয়ে প্রিয় নবী সা: সাহাবায়ে কেরামের হৃদয়ে ইনসাফের বীজ বপন করে দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ন্যায়বিচারকরা (কিয়ামতের দিন) আল্লাহর কাছে নূরের মিম্বরসমূহে মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডানপাশে উপবিষ্ট থাকবেন। তাঁর উভয় হাতই ডান হাত (অর্থাৎ সমান মহীয়ান)। যারা তাদের শাসনকাজে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বগুলোর ব্যাপারে সুবিচার করে।’ (মুসলিম-৪৬১৫)
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সা: সমাজে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। মানবজীবন পরিচালনা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা: সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণের মধ্যেই আমাদের ইহকালীন সাফল্য ও পরকালীন মুক্তি নিহিত।
লেখক : ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা