সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য কেউ কাঁদে না
- জাফর আহমাদ
- ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
আসমান ও জমিনে সীমালঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহীর জন্য কেউ কাঁদে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অতঃপর না আসমান তাদের জন্য কেঁদেছে না জমিন এবং সামান্যতম অবকাশও তাদের দেয়া হয়নি’ (সূরা দুখান-২৯)। আয়াতটি ফেরাউন সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। ফেরাউনের বিদ্রোহ ও সীমালঙ্ঘন সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি।
আসলে এ ধরনের শাসকরা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন চারদিকে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের ডঙ্কা বাজতে থাকে। তাদের প্রশংসার গীত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। তাদের আগে পেছনে চাটুকারদের ভিড় লেগে থাকে। তাদের এমন ভাবমর্যাদা সৃষ্টি করা হয় যেন গোটা দেশই তাদের গুণাবলির ভক্ত-অনুরক্ত, তাদের দয়া ও করুণার দানে ঋণী এবং পৃথিবীতে তাদের চেয়ে জনপ্রিয় আর কেউ নেই। কিন্তু যখন তাদের পতন হয় একটি চোখ থেকেও তাদের জন্য অশ্রুপাত হয় না; বরং সবাই প্রাণ ভরে এমন শ^াস নিতে থাকে যেন তার পাঁজরে বিদ্ধ কাঁটাটি বের হয়ে গিয়েছে। এ কথা সবারই জানা, তারা আল্লাহর বান্দাদের কোনো কল্যাণ করেনি যে তারা তার জন্য কাঁদবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যও কোনো কাজ করেনি যে, আসমানবাসীরা তাদের ধ্বংসের কারণে আহাজারি করবে।
আল্লাহর ইচ্ছানুসারে যত দিন তাদেরকে অবকাশ দেয়া হয়েছে তত দিন তারা পৃথিবীর বুকে দুর্বলদের অত্যাচার করেছে। কিন্তু তাদের অপরাধের মাত্রা সীমালঙ্ঘন করলে এমনভাবে ছুড়ে ফেলা হয়, যেমন ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। অবকাশের সময় নির্দিষ্ট করার মানে এই নয় যে, তাদের জন্য বছর, মাস, দিন ধরে একটি আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট করা হয় এবং এ সময়টি শেষ হয়ে যেতেই তাকে অবশ্যই খতম করে দেয়া হয়; বরং এর মানে হচ্ছে, এদেরকে যে শাসন ক্ষমতা দেয়া হয়, তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে ভালো ও মন্দের আনুপাতিক হার কমপক্ষে কতটুকু বরদাশত করা যেতে পারে, এ অর্থে তার কাজ করার একটি নৈতিক সীমানা চিহ্নিত করা হয়। যত দিন একজন শাসকের মন্দ গুণগুলো তার ভালো গুণাবলির তুলনায় ওই আনুপাতিক হারের সর্বশেষ সীমার মধ্যে অবস্থান করতে থাকে তত দিন তাকে তার সব অসৎকর্ম সত্ত্বেও অবকাশ দেয়া হয়। আর যখন তা ওই সর্বশেষ সীমানা পার হয়ে যায় তখন এ ধরনের অসৎ কর্মশীল শাসককে আর কোনো বাড়তি অবকাশ দেয়া হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেবেন। প্রকৃত ব্যাপার হলো- আল্লাহর নির্ধারিত সময় যখন এসে যায় তখন তা থেকে বাঁচা যায় না। আহ! যদি তোমরা তা জানতে’ (সূরা নূহ-৪)।
মূলত: যেদিন থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে সে দিন থেকেই আল্লাহর অবকাশ শুরু হয়। যারা মানবতার কল্যাণে কাজ করে তারা মূলত অবকাশকে সঠিক কাজে ব্যয় করে। তারা আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করে না। তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা। আর যারা নিজের সীমানা অতিক্রম করে এমন একটি সীমানায় পদার্পণ করে যেখানে প্রবেশ করার অধিকার তার নেই। অর্থাৎ যারা সীমালঙ্ঘন করে সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর রাজ্যে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও আচরণ গ্রহণ করে, যারা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে থেকেও নিজেদের অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্বের ডঙ্কা বাজায় এবং যারা মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তারা সবাই বিদ্রোহী গণ্য হয়। তাদের ওপরই নির্দিষ্ট অবকাশের সীমা অতিক্রমের পরপরই আল্লাহর গজবের মুষ্টিবদ্ধ হাত আবর্তিত হয়। অর্থাৎ আল্লাহর গজবে নিপতিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এমন একসময় আসা বিচিত্র নয় যখন আজ যারা অস্বীকার করছে, তারা অনুশোচনা করে বলবে- হায়, যদি আমার আনুগত্যের শির নত করে দিতাম! ছেড়ে দাও এদেরকে, খানাপিনা করুক, আমোদ ফুর্তি করুক এবং মিথ্যা প্রত্যাশা এদেরকে ভুলিয়ে রাখুক। শিগগির এরা জানতে পারবে’ (সূরা হিজর : ২-৩)।
যেই নেতৃত্ব জুলুমতন্ত্র কায়েম করে। রাষ্ট্রের সব স্তরে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অশান্তি আর অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্বেষ, পেশিশক্তি, সঙ্কীর্ণ গোত্র বা বংশমর্যাদা এবং কুৎসিত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ দানা বেঁধে ওঠে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করে সাধারণ মানুষকে চরম অসহায়ত্বে নিক্ষেপ করে, মানবিক অধিকার বঞ্চিত দাসানুদাসে পরিণত করতে থাকে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ফলে জনগণের ওপর মর্মস্পর্শী স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনা হতে থাকে এবং আল্লাহর বিধিবিধান বিভিন্নভাবে অবহেলিত হতে থাকে। রাষ্ট্রের সহায়তায় মদ ও বারের আসন জমজমাট হতে থাকে। যেসব প্রতিষ্ঠানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, সেগুলো গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। রাষ্ট্রশক্তি একটি স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়ে চরম অহঙ্কারী ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়। যা চিন্তা করা হতো, তার যৌক্তিকতা সবাইকেই মেনে নিতে থাকে। বলে দেয়া হয়, সে বিষয়ে জনগণের কিছু বলার সুযোগ থাকে না। তার কথাই হবে আইন, জনগণকে তা অকুণ্ঠিত মনে ও নির্বাকচিত্তে মেনে নিতে হবে। তার শাসনের জাঁতাকলে জনগণ নির্বোধ বনে যায়। কেউ তার স্বাধীন চিন্তা-বিবেচনা শক্তির প্রয়োগ করতে পারে না।
নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এরা আন্তর্জাতিক স্বৈরাচারের পদলেহন করে। আন্তর্জাতিক স্বৈরাচার দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে বিভিন্ন অজুহাত তথা ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’, ‘সন্ত্রাস দমন’ ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে দেশে যেখানে যেটি প্রযোজ্য সেটি ব্যবহার করে মূলত তারাই সন্ত্রাস করে যায়। জোরপূর্বক নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক ও জুলুমতান্ত্রিক চিন্তাধারা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোশেশ করে। অন্য দিকে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গায়ের জোরে পাশবিক আচরণ করে। এদের কোনো দেশের সীমানাপ্রাচীর অতিক্রম করে মারণাস্ত্র নিয়ে অন্যের প্রাচীরের ভেতর প্রবেশ করার জন্য কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। অন্যের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বকে যেকোনো সময় তছনছ করে প্রবেশ করার অধিকার দেয়া হয়। কারো নিন্দা জ্ঞাপন বা আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে সে পরোয়া করে না। যারা পৃথিবীর দেশে দেশে বহু দালাল ও লোভী শ্রেণীর স্বৈরাচার সৃষ্টি করে।
এই উভয় শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যে গভীর মিল রয়েছে। তা হলো- ইসলামের সাথে বৈরিতা পোষণ করা। এরা উভয়েই ইসলামকে খুবই ভয় পায়। কারণ অন্যান্য শ্রেণী-গোষ্ঠীর লোক হয়তো একসময় স্বৈরতন্ত্রের সাথে মিশে যেতে পারে। কিন্তু ইসলাম, ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী কখনো স্বৈরতন্ত্রের সাথে হাত মেলাতে পারে না; বরং ইসলাম স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে সেখানে ন্যায়-ইনসাফ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এ জন্য স্বৈরাচারদের পথে প্রথম ও প্রধান বাধা হলো ইসলাম। তাই তারা প্রথমে ইসলামকে উৎখাত করার চেষ্টা চালায়। নানা অজুহাত সৃষ্টি করে এদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়।
এদের যখন পতন হয় অথবা মারা যায় তখন দেশের জনগণ কাঁদবে তো দূরের কথা উল্টো মানুষগুলো আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করতে থাকে। মনে হয় যেন তারা বুকের ওপর চাপা পড়া বিশাল পাথর থেকে অবমুক্ত হয়েছে। চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মূক সব তখন মুখরিত হয়ে ওঠে। বন্দী বিবেক মুক্ত বাতাসে শ^াস নিতে থাকে। দুর্বলরা শারীরিক শক্তিমত্তা ফিরে পায়। মৃত জনপদ অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে সবুজ পল্লবীতে।
লেখক : প্রবন্ধকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা