০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিম কেন হবো

-

(অষ্টমাংশ)
সম্মানিত মুমিন ভাই ও বোন, আলোচ্য শিরোনামের অতুলনীয় গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ঈমানের উপকারিতা সম্পর্কে লেখার ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে। ইতোপূর্বে ক্রমিক ৭ সম্পন্ন হয়েছিল, বর্তমানে ক্রমিক ৮ থেকে শুরু হচ্ছে পরিপূর্ণ ঈমানের উপকারিতা প্রসঙ্গে।
৮. আল্লাহর বাণী- ‘আর এভাবেই আমি আমার নির্দেশে তোমার প্রতি ওহি করেছি রুহ তথা আল কুরআন। তুমি তো জানতে না যে, কিতাব কী এবং ঈমান কোন জিনিস। পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো, যা দ্বারা আমি আমার গে মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি। নিশ্চয় তুমি সরল পথের দিকেই পথপ্রদর্শন করে থাকো।’ (সূরা শুরা-৫২) আলোচ্য আয়াতে লক্ষণীয়, আল্লাহ কুরআন এবং পরিপূর্ণ ঈমানকে করেছেন- ‘আলো যা আল্লাহর ইচ্ছানুসারে আমাদের সরল-সঠিক পথ বা সিরাতুল মুস্তাকিম নির্দেশক।’ আমরা পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিম হতে পারলে ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাব ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ বা সরল-সঠিক পথ যে পথের শেষ প্রান্তে জান্নাত অবস্থিত যা মুমিন মুসলিমদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল।
৯. আল্লাহর বাণী- ‘যখনই কোনো সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এটা তোমাদের মধ্যে কারো ঈমান বৃদ্ধি করল কি? এরপর যারা ঈমান আনয়ন করেছে এতে তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায় এবং তারাই আনন্দিত হয়।’ (সূরা তাওবা-১২৪)
আলোচ্য আয়াতে ঈমান বৃদ্ধির অর্থ প্রতিটি পরীক্ষার সময় আল্লাহ তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং সঠিক পথে চলার সুযোগ দান করেন। তাদের অসৎকাজ ও ভ্রান্তপথ থেকে রক্ষা করেন। ফলে তারা তাঁর পথনির্দেশনার মাধ্যমে সত্য ও সঠিক পথে এগিয়ে চলতে সক্ষম হয়।
১০. আল্লাহর বাণী- ‘হে রাসূল! তুমি কি লক্ষ করো না যে, আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? কালিমাতুল তায়্যিবাতুল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ)-এর তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষের সাথে, যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত, যা প্রত্যেক মওসুমে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে ফল দান করে। আর আল্লাহ মানুষের জন্য এসব উপমা দিয়ে থাকেন, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।’ (সূরা ইবরাহিম : ২৪-২৫)
‘কালিমায়ে তায়্যিবা’-এর শাব্দিক অর্থ ‘পবিত্র কথা’। কিন্তু এ শব্দের মাধ্যমে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে- এমন সত্য কথা এবং এমন পরিচ্ছন্ন বিশ্বাস, যা পুরোপুরি সত্য ও সরলতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ কালিমা চিন্তাধারায় পরিপক্বতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আত্মায় প্রফুল্লøতা, শরীরে পরিচ্ছন্নতা, আচার-ব্যবহারে মাধুর্যতা, লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, অঙ্গীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন-যাপনে স্বচ্ছতা, কৃষ্টি-কালচারে ঔদার্য ও মহত্ব, সভ্যতায় ভারসাম্য, অর্থনীতিতে ন্যায়পরায়ণতা, রাজনীতিতে বিশ্বস্ততা, যুদ্ধে সৌজন্যতা, সন্ধিতে আন্তরিকতা, চুক্তিতে বিশ্বস্ততা ইত্যাদি সৃষ্টি করে। এটি এমন একটি পরশপাথর, যার প্রভাব কেউ যথাযথভাবে গ্রহণ করলে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়। এ কালিমার বদৌলতে তারা দুনিয়ায় একটি স্থায়ী দৃষ্টিভঙ্গি, শক্তিশালী চিন্তাধারা এবং একটি ব্যাপক জীবনদর্শন লাভ করে। জীবনের সব সমস্যার সমাধানে তা এমন এক চাবির ন্যায় কাজ করে, যা দিয়ে সব কর্মের তালা খোলা যায়। এর সাহায্যে জীবন-যাপনের এমন কতগুলো মূলনীতি পাওয়া যায়, যা একদিকে হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে প্রশান্তি এনে দেয় এবং অন্যদিকে প্রচেষ্টা ও কর্মের পথে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ানোর এবং অস্থিরতার শিকার হওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। তারপর তারা মৃত্যুর সীমানা অতিক্রম করে পরলোকের সীমান্তে পা রাখে, তখন সেখানে তারা চিন্তিত হয় না। কারণ সেখানে তাদের প্রত্যাশানুযায়ী সব কিছু পেয়ে থাকে।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ কর্তৃক-‘গাছের তুলনাটি’ নিয়ে একটু আলোচনা করছি। পরিপূর্ণ মুমিনের সততা ও সৎকাজের ভিত্তি আলোচ্য বৃক্ষের শিকড়ের ন্যায় সুদৃঢ় এবং শাখা-প্রশাখার ন্যায় সর্বত্র বিস্তৃত তার অবদান সাথে সাথে এবং সর্বদা প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে ফলের ন্যায় মানবকল্যাণ সাধন করতে থাকে। আসুন আমরা সীমাহীন কল্যাণকামী আল্লাহর এ উদাহরণ থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করি যাতে করে ইনশাআল্লাহ আমরা হতে পারি অতুলনীয় মানব কল্যাণ সাধনের স্বার্থে পরিপূর্ণ মুমিন। নিঃসন্দেহে ইসলাম শান্তি বা কল্যাণ সাধনের ধর্ম। আজ আমরা অসুখ অশান্তির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি তার একমাত্র কারণ যথাযথ ঈমান ইসলাম বর্জিত জীবনযাপন। অত্যাচার-অবিচার, দুর্নীতি, অরাজকতা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদিতে ভরপুর মানবসমাজ।
১১. আল্লাহর বাণী- ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাদের যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন (অর্থাৎ ধন-সম্পদ, জ্ঞান, শক্তি-সামর্থ্য দান করেছেন) তা হতে ব্যয় করো (জনকল্যাণের স্বার্থে)। অতএব তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছ না? অথচ রাসূল তোমাদের আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে আহ্বান করছেন এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারও গ্রহণ করেছেন। (আফসোস!) যদি তোমরা ঈমান আনতে, (তবে কতই না ভালো হতো)।’ (সূরা হাদিদ : ৭-৮)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন মহাপুরস্কার বা মহাকল্যাণ অর্থাৎ- জান্নাত, চির শান্তির ও ভোগ বিলাসবহুল স্থান, সেখানে মন যা চাইবে তা-ই পাওয়া যাবে, যা মুখে উচ্চারণ করবে তাই উপস্থিত হবে। আলোচ্য আয়াতে ঈমান সম্পর্কে আমাদের অঙ্গীকারের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা আল্লাহর বাণী দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ হজরত আদম আ:-কে সৃষ্টি করা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে সৃষ্ট সব মানুষের রুহকে একত্রিত করে আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ‘আলাসতু বি রাব্বি কুম ক্বালু বালা’ (সূরা আল-আ’রাফ-১৭২) অর্থ- ‘আমি (আল্লাহ) কি তোমাদের (সর্বকালের সব মানস) প্রতিপালক বা প্রভু নই?
এ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার এবং এর বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে তাফসিরে নূরুল কুরআন অবলম্বনে আলোচনা করছি।
‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ সেদিন কে দেবে এ প্রশ্নের জবাব? একমাত্র হজরত আদম আ: জীবন্ত মানুষ আর বাকি সব রুহ, যাদের ক্ষুদ্র পিপীলিকার ন্যায় একত্রিত করা হয়েছে। সেদিন সর্বপ্রথম যিনি সমগ্র মানব জাতির তরফ থেকে মহান আল্লাহ পাকের এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন, তিনি হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আমাদের প্রিয়নবী হজরত রাসূলে করিম সা:। তিনিই বলেছেন সর্বপ্রথম ‘বালা’ হ্যাঁ, নিশ্চয় তুমিই আমাদের প্রতিপালক। তুমিই আমাদের স্রষ্টা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা। প্রিয়নবী সা:-এর এ জবাবের অনুসরণ করেন সব আম্বিয়ায়ে কেরাম, আউলিয়ায়ে কেরাম তথা সমগ্র মানব জাতি। তাই পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে- ‘ক্বালু বালা’ তখন সবাই বলে, ‘প্রভু তুমিই আমাদের রব, তুমিই আমাদের পরওয়ারদিগার।’ সেদিন আল্লাহ পাকের রবুবিয়্যতের অঙ্গীকার করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ করেছিল প্রতিটি মানুষ। যদিও দুনিয়াতে আসার পর অনেকেই আত্মবিস্মৃত হয়েছে, ভুলে গেছে কৃত অঙ্গীকারের কথা, তাই আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ পাক সেই ঐতিহাসিক অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিত সম্মুখে রেখেই মরমি কবি আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন (বক্তব্য উর্দু কবিতায় বর্ণিত), অর্থাৎ- সৃষ্টির প্রথম দিনই তো আল্লাহ পাকের রুবুবিয়্যত ও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অঙ্গীকার করে এসেছ আর এখানে এসে মূর্তিপূজা শুরু করেছ, একটু চিন্তা করো সেখানে কি বলে এসেছ আর এখানে কি করছ।’
আলোচ্য আয়াত থেকে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই আমাদের অঙ্গীকার ভুলে না যাই। মনে প্রাণে আল্লাহকে বিশ্বাস করি প্রতিপালক হিসেবে এবং পালন করতে থাকি তার আদেশ ও নিষধাজ্ঞাগুলো পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিম হয়ে।
হে পরম করুণাময় আল্লাহ! দয়া করে আপনার গোলামদের তাওফিক দিন তারা যেন আপনার সাথে করা অঙ্গীকার পালন করতে সক্ষম হয় পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিম হয়ে এব উপরোক্ত অঙ্গীকার পূরণ করে। অর্জন করতে পারে উপরোক্ত মহাপুরস্কার, মহাকল্যাণ বা জান্নাতপ্রাপ্ত হওয়ার চরম-পরম সফলতা, আমিন। (চলবে)
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ।


আরো সংবাদ



premium cement