২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বজ্রপাতের নাটকে হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা, অভিযোগের তীর চুন্নুর বিরুদ্ধে

কিশোরগঞ্জ - ছবি : নয়া দিগন্ত

বজ্রপাতের নাটক সাজিয়ে রেদওয়ান আহম্মেদ খান লিজন নামে এক যুবকের হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে জাপা মহাসচিব ও কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে করিমগঞ্জ উপজেলার গুণধর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে এলাকাবাসীর আয়োজনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে এ অভিযোগ তোলা হয়।

নিহত রেদওয়ান আহম্মেদ খান লিজন গুণধর গ্রামের মরহুম আমিনুল ইসলাম খানের ছেলে। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কিশোরগঞ্জ-মরিচখালী সড়কের পানাহার গ্রামের সামনে মাদলের ব্রিজের নিচ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, স্বৈরাচার সরকারের দোসর জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর মদদে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। পরে পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে এই হত্যাকে অপমৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়া হয়। বজ্রপাতের নাটক সাজিয়ে লিজনের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়েছিলেন চুন্নু। এ ঘটনাটি পুনঃতদন্ত করে বিচার চাই আমরা। আমাদের বিশ্বাস পুনঃতদন্ত হলে এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের নাম চলে আসবে। যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ফাঁসিতে ঝুলানোর দাবি জানাচ্ছি। এতে নিহতের আত্মা শান্তি পাবে।'

মানববন্ধনে বক্তব্য দেন, নিহত লিজনের মা রুবিয়া আক্তার, বড় ভাই আশিক মিয়া, জয়কা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির, গুণধর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আশরাফ আলী, করিমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শাহ মো. হেদায়েত উল্লাহ, উপজেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুকছেদুল মমিন সবুজ, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক পারভেজ, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক জিয়ন কামাল, গুণধর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।

বক্তৃতায় লিজনের বড় ভাই আশিক খান বলেন, 'আমি বিএনপির রাজনীতি করি বলে আমার ভাইকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড মুজিবুল হক চুন্নুর মদদে হয়েছে। পরে এই হত্যাকাণ্ডকে বজ্রপাতে নিহত বলে চালিয়ে দেয়া হয়। অথচ আমার ভাইয়ের হত্যাকান্ডের দু'দিন আগে থেকে দু'দিন পর পর্যন্ত এলাকায় কোনো বজ্রপাত হয়নি, বৃষ্টিপাত হয়নি। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে এটাই মহাসত্য, আর এই মামলা ডিসমিস করে দেয় মুজিবুল হক চুন্নু । এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি এই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত চাই। আমি আমার ভাইয়ের হত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তি চাই।'

লিজনের মা রুবিয়া আক্তার বলেন, 'গত সরকারের সময় আমরা বিচার পাই নাই। এ সরকারের কাছে আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।'

লিজনের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লিজন খান ঢাকার নাবাবগঞ্জে একটি জুতার কারখানায় চাকরি করতেন।

ঘটনার দিন (২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার) দুপুরে তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে মাদলের ব্রিজের নিচে যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন করিমগঞ্জ থানায় খবর দেয়। পুলিশ সেখানে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। নিহত লিজনের লাশের পাশ থেকে কয়েক জোড়া স্যান্ডেল, প্লাস্টিকের (কোল্ড ড্রিংক্সের) তিনটি বোতল ও একটি মোবাইল সেট পায়। উদ্ধারকৃত মোবাইল সেটটি লিজন খানের বলে জানিয়েছিলো পুলিশ। নিহতের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল।

পরিবারের লোকজন জানায়, ঢাকা থেকে এসে বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘোরাঘুরি করে রাত ১০টার দিকে বাড়ির ঘরে লিজন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমানোর ১০ থেকে ২০ মিনিট পর কে বা কারা ফোন করে তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে লাশ পাওয়া যায়।

এই ঘটনায় লিজনের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। করিমগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি মমিনুল ইসলাম জোর করে অপমৃত্যুর মামলা নেয়। করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালে ৮ নভেম্বর চারজনের নাম উল্লেখ করে লিজনের বড় ভাই পারভেজ মিয়া কিশোরগঞ্জের আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

তদন্তের জন্য এই মামলা সিআইডি বা পিবিআই এর কাছে দেয়ার দাবি করছিল বাদি পক্ষ। আদালত তা নাকচ করে পুনরায় তদন্ত করিমগঞ্জ থানাকেই দেয়। পরে এই মামলাকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয় থানা থেকে। পরিবারের অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডকে বজ্রপাতে নিহত বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর নেপথ্যে কাজ করে মুজিবুল হক চুন্নু এবং তৎকালীন ওসি মমিনুল হক। তারা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ঘুরিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর নাটক সাজায়।

সুত্র জানায়, করিমগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি মো: মমিনুল ইসলাম লিজনের নাকে-মুখে রক্তাক্ত কাটা দাগ ছিলো জানিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি আরও জানিয়েছিলেন 'আমরা এখনো ধারণা করতে পারছি না এটা হত্যা নাকি অপমৃত্যু। তিনটি বোতলের মধ্যে যে খালি বোতলটি পাওয়া গেছে সেটি কীটনাশক বা এরকম কিছু বলে ধারণা করা হচ্ছে। লাশের বুকে, পেটে যে কালো দাগ হয়ে আছে, বজ্রপাতের আঘাতের মতো মনে হচ্ছে। মাথার আঘাতটি ইটের আঘাতের মতো মনে হচ্ছে।'

তবে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করে জাপা মহাসচিব ও কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, 'এটা আল্লাহই জানে ভাই। আমি কিছু বলতে পারবো না।'

করিমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মিজানুর রহমান বলেন, 'তখন আমি ছিলাম না। আমি তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে বিষয়টি দেখবো।'

 


আরো সংবাদ



premium cement