০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নরসিংদী কারাগারে সেদিন কী ঘটেছিল

হামলার পরদিন ২০ জুলাই কারাগারের ভেতর অবাধে ঘোরাফেরা করছেন কয়েদিরা - ছবি : বিবিসি

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বাংলাদেশে ঘটেছে একটি কারাগারে থাকা সকল বন্দি পালানোর মতো নজীরবিহীন ঘটনা। ১৯শে জুলাই বিক্ষোভাকারীরা নরসিংদী কারাগারে হামলা করলে নয়জন উগ্রবাদীসহ কারাগারে থাকা আটশত ছাব্বিশ বন্দির সকলেই পালিয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এদের ৪৬৫ জন আত্মসমর্পণ করে। তিন উগ্রবাদীসহ সাতজনকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। তবে এখনো পলাতক সাড়ে তিন শ’রও বেশি কয়েদি।

সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল

কারাগারের মতো সুরক্ষিত জায়গায় হামলা কেন ঠেকানো গেলো না? এসব প্রশ্ন এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যেই অবশ্য দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বরখাস্ত করা হয়েছে কারাগারের জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ এবং জেলার কামরুল ইসলামকে।

১৯শে জুলাইয়ের হামলায় কারাগারের মূল ফটক, কয়েদখানা, রক্ষীদের ব্যারাক এবং কারা হাসপাতাল- সবখানেই অগ্নিসংযোগ করা হয়।

‘আইনের পোশাক খুইল্যা লুঙ্গি পইরা নিছে’
দুপুর আনুমানিক সাড়ে ৩টা। কারাগারে সেবক হিসেবে থাকা কয়েদি মাসুদ আলী ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। এমন সময় বাইরে থেকে ব্যাপক হট্টগোল শুনতে পান তিনি।

‘সমানে দেয়ালের উপর দিয়া বোমা মারতেছিলো ভিতরে। তারপর হঠাৎ গেট ভাইঙ্গা অনেক মানুষ ভিতরে ঢুইকা পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে ভাঙচুর, আগুন দেয়া শুরু করলো। মনে হইতেছিলো ভিতরে আগুনে মইরা যামু। এমন সময় গেটের তালা ভাইঙ্গা আমারে কইলো বাইর হ, আমি তখনই দৌড় দিলাম।’

কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে বিবিসি বাংলাকে সেদিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করছিলেন পালিয়ে যাওয়া কয়েদি মাসুদ আলী। তিনদিন বাড়িতে পালিয়ে থাকার পর অবশ্য তিনি শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পনের জন্য আসেন নরসিংদী কারাগারের সামনে। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে।

‘আমরা অনেকেই বাইরে যাইতে চাই নাই। কিন্তু আগুনের ডরে গরাদ থেকে বাইর হইছি। এরপর হামলা করা লোকগুলান আইসা বলে, পলায়া যা। আমার মাত্র দুই মাস সাজা আছে। তাই আমি কইছি, যামু না। তখন লাঠি দিয়া মাইর দিছে।’

কিন্তু এই হামলার সময় কারারক্ষীরা সেখানে কী করছিলেন এমন প্রশ্নে মাসুদ জানান, সেই সময় তিনি কোনো কারারক্ষী বা পুলিশ কাউকেই দেখেননি। কারাগারের বাইরেও কেউ ছিল না। পালিয়ে যেতেও কেউ বাধা দেয়নি।

তবে খোরশেদ নামে আরেকজন কয়েদি জানাচ্ছেন, হামলার মধ্যে কারারক্ষীরা সেটা ঠেকানোর সময় পাননি। এমনকি হামলা থেকে বাঁচতে কয়েদি সেজেও রক্ষীদের অনেকে পালিয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘অবস্থা এমন হইছে যে, কারাগারের লোকও আমাদের মতোন আসামির বেশ ধরছে। হ্যারা আইনের পোশাক খুইল্যা লুঙ্গি পইরা নিছে। হ্যাগারো আর চেনা যায় না।’

হামলা কেন ঠেকানো গেলো না
স্থানীয় সাংবাদিক এবং পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কারাগারে ১৯ জুলাইয়ে হামলার আগে প্রথম হামলা হয় নরসিংদীর মাধবদীতে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়ে পৌরসভায় হামলা করে। ব্যাপকভাবে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়।

এর কিছুক্ষণ পরই কারাগার থেকে কয়েকশত গজ দূরের জেলা পরিষদ ভবনে হামলা হয়। সেখানেও ভেতরে ঢুকে বিভিন্ন আসবাবপত্র এবং সম্মেলন কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। রাস্তায় কয়েকটি যানবাহনেও দেয়া হয় আগুন।

সেসময় কারাগারের পাশে চৌরাস্তার মোড়েও বিভিন্ন ভবন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভাকারীদের একটি অংশ। আরেকটি অংশ হঠাৎ কারাগারের দিকে এগিয়ে যায়। বিক্ষোভকারীরা অনেকটা বাধা ছাড়াই মূল ফটক ভেঙে কারাগারের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কারাগারে সেদিনের হামলায় রক্ষীদের ব্যারাক, কর্মকর্তাদের বাসভবন আক্রান্ত হয়। হামলাকারীরা সেসব জ্বালিয়ে দেয়, ভাঙচুর করে।

পাশাপাশি হামলাকারীদের একটি অংশ কয়েদখানার দিকে গিয়ে লকার ভেঙে ফেলে। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েদি এবং কারারক্ষীরা জানাচ্ছেন, লকার ভাঙতে আসা ব্যক্তিরা ছিলেন কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত।

প্রতিটি গ্রুপে ৮ থেকে ১০ জন করে সদস্য ছিল। তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র, রামদা এবং তালা ও লোহার গেট ভাঙার জন্য ‘হ্যামার’ ছিল।

এসব ব্যক্তি কয়েদিদের মুক্ত করে দেয়। এছাড়া নয় উগ্রবাদীকে ছাড়িয়ে আনে। এরপর লুট করে অস্ত্রাগারে থাকা ৮৫টি অস্ত্র। সবকিছুই করা হয়েছে দ্রুততম সময়ে।

কারাগারে হামলা, বন্দী পালানো এবং অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনায় ইতোমধ্যেই বরখাস্ত করা হয়েছে জেল সুপার এবং জেলারকে। কিন্তু এসবের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে কারাগারে নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও সেদিন হামলা কেন ঠেকানো যায়নি?

বরখাস্ত হওয়া জেলসুপার আবুল কালাম আজাদ অবশ্য হামলার পরদিনই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার ভাষায়, আচমকা এই হামলা ঠেকানোর উপায় ছিল না।

‘দেয়াল টপকে, গেট ভেঙে জেলখানার সবদিক দিয়েই দশ থেকে বারো হাজার লোক ঢুকে পড়ে,’ সেদিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করছিলেন আজাদ।

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রস্তুতি নিতে নিতেই তারা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেলো। আমরা মূল কয়েদখানার দিকে চলে আসলাম। প্রতিটি কামরায় তালা মারা হলো। পরে দেখা গেলো তারা বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র এনেছে। হাতে হ্যামার ছিল। হ্যামার দিয়ে তারা গেট ভাঙ্গা শুরু করলো। দশ থেকে বারো হাজার লোকের সঙ্গে আমরা কি তখন কিছু করতে পারি?’

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কারারক্ষী জানিয়েছেন, হঠাৎ হামলায় কারারক্ষীরা 'একরকম জিম্মি' হয়ে পড়েন। অনেকেই মারধরের শিকার হন। রক্ষী এবং কর্মকর্তাদের বাসভবনে আগুন লাগলে তাদের অনেকেই পরিবারকে বাঁচাতে ছুটে যান এবং যে যার মতো জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

পুলিশ কেন কারাগারে হামলা ঠেকাতে সময়মতো আসেনি
কারাগারে হামলায় যেমন কারারক্ষীদের ব্যর্থতা সামনে আসছে, তেমনি কারাকর্তৃপক্ষ থেকেও দাবি করা হচ্ছে, সেসময় পুলিশের কাছে সহায়তা চেয়েও তারা পাননি।

এমন অবস্থা কেন হলো

এমন প্রশ্নে নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান অবশ্য বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, খবর পাওয়া মাত্রই তারা কারাগারে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু তার ভাষায়, ‘কারাগারেও যথেষ্ট ফোর্স ছিল, তাদের ট্রেনিংও আছে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কারা কর্তৃপক্ষ সেটা কাজে লাগাতে পারেনি।’ এছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে খুব দ্রুত পৌছানোর উপায় ছিল না।

‘আমাদের এদিকেও প্রচণ্ড হামলা হয়েছে। আমরা সেগুলো সামাল দিচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের উপরও গুলি ছোড়া হয়। তখন আমি জেল সুপারকে ফোন দিয়ে বলি যে, আপনি কোথায় আছেন? কারাগার থেকে কোনো অস্ত্র লুট হয়েছে কি না।’

‘তখন তিনি বললেন, সম্ভবত অস্ত্র লুট হয়েছে। তিনি পালিয়ে আছেন। এখন তাদেরকে আমরা সহায়তা করবো, কিন্তু যারা সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর গুলি করছে, তাকে তো প্রতিহত করে তারপর তাদেরকে সহায়তা করতে হবে।’

পুলিশ সুপার বলছেন, হামলার মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের কারাগারের দিকে এগুতে হয়েছে।

‘এখানে ইচ্ছা করলেই তো দশ মিনিটে আমরা পৌঁছে যাবো এমন না। আমরা তখন একটু সম্মুখ যুদ্ধে। আমাদের ফোর্সকে ক্রলিং করে শুয়ে শুয়ে সামনে এগুতে হয়েছে। তখন পরিস্থিতিটা ছিল এমন।’

থমথমে নরসিংদী
নরসিংদীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গেলো সপ্তাহের বিক্ষোভে কারাগার এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়ায় বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয় বিভিন্ন স্থাপনায়।

স্থানীয় প্রশাসন এবং হাসপাতাল সূত্রে কয়েকদিনের সহিংসতায় অন্তত ১৩ জন নিহতের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে নিহতের আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

সব মিলিয়ে নরসিংদীতে ব্যাপক সংঘাত, কারাগারে হামলা ও বন্দি পালানোর মতো নজিরবিহীন ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও ভয় এবং উদ্বেগ কাজ করছে।

শনিবার থেকেই অবশ্য নিরাপত্তা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষত কারাগার ঘিরে। প্রতিদিনই কারাগার থেকে পালানো বন্দিদের অনেকে আত্মসমর্পণ করছেন।

তবে এসব কয়েকদিকে আপাতত কারাগারে ঢুকতে না দিয়ে পাঠানো হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের জন্য।

নরসিংদীর জেলা আইনজীবী ভবনে গিয়ে এরকমই শখানেক কয়েদিকে দেখা যায়, যারা সকলেই এসেছেন আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করতে।

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বদিউল আলম জানিয়েছেন, কারাগারে হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় এখন দুটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তবে ফিরে আসা সব কয়েদিকে এখনই নরসিংদী কারাগারে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

‘বাইরের যে নিরাপত্তা, সেটার ব্যবস্থা আমরা করেছি। ভেতরেও বিজিবি এবং অন্যান্য ফোর্স রাখা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সংযোগ পুনর্স্থাপন করা হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্রের অনেকগুলো ইতোমধ্যে উদ্ধার হয়েছে। অনেকে আত্মসমর্পনও করছেন।’

নরসিংদীর পুলিশ প্রশাসন এবং আদালত সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন পালিয়ে যাওয়া ৪৬৫ কয়েদি। এছাড়া তিন উগ্রবাদীসহ আরো ৭ জন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। কিন্তু এখনও কারাগারের বাইরে সাড়ে তিনশোরও বেশি কয়েদি।

এসব কয়েদিকে আত্মসমর্পণ করানো এবং উগ্রবাদী ও ফিরতে না চাওয়াদের গ্রেফতার করাটাই এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
এ সরকার জনপ্রত্যাশার কী করবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন : তাজুল ইসলাম চিফ প্রসিকিউটর আবুধাবির কারাগার থেকে দেশে ফিরেছেন ১৪ বীর কোনাবাড়ীতে কলেজছাত্রকে গুলি করে হত্যা : কনস্টেবল গ্রেফতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্তগুলো যৌক্তিক : ফখরুল ‘একটি চক্র জামায়াত আমিরের বক্তব্য নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ অস্ত্র জমা দেয়নি শামীম ওসমান ও গাজী পরিবার এবি পার্টির উপদেষ্টার পদ ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক কর্মকর্তাদের তালিকা চাওয়া নিয়ে বিতর্কে মন্ত্রণালয়ের দুঃখ প্রকাশ আশুলিয়ায় শ্রমিক দলের সমাবেশে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ৫ রূপগঞ্জে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা

সকল