০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮ ভাদ্র ১৪৩১, ২৭ সফর ১৪৪৬
`

কিশোরগঞ্জে দিনভর সংঘর্ষে শহর রণক্ষেত্র, আহত দেড় শতাধিক

কিশোরগঞ্জে দিনভর সংঘর্ষে শহর রণক্ষেত্র, আহত দেড় শতাধিক - ছবি : নয়া দিগন্ত

কোটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিকে ঘিরে কিশোরগঞ্জে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগ, র‌্যাব-পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কিশোরগঞ্জ জেলা শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা পৌনে ১২টার দিকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ব্যাপক এই সংঘর্ষে সাত সাংবাদিক, পুলিশ ও শতাধিক শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১৫০ জন আহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির সমর্থনে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার দিকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। বেলা পৌনে ১২টার দিকে শহরের আঠারোবাড়ি কাচারি মোড়ে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিলের ওপর রাম দা, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা গুলি ছুঁড়ে ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এছাড়াও কুপিয়ে তারা বেশ কয়েকজন ছাত্রীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত করে। এ পরিস্থিতিতে আঠারোবাড়ি কাচাড়ি মোড় থেকে রথখোলা নূর মসজিদ এলাকা পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় রথখোলা এলাকার একটি বিপনী বিতানের বহুতল ভবনে কয়েকজন শিক্ষার্থী আশ্রয় নিলে সেখানেও তাদের ওপর হামলা চালিয়ে আহত করা হয়। ছাত্রলীগের এ হামলা ও মারপিটে সেখানে অন্তত ২০ জন সাধারণ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছে। এর জের ধরে সংঘর্ষ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

শহরের পুরানথানা মোড়, গৌরাঙ্গবাজার মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করা শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে মুহূর্মুহু গুলি ও টিয়ারশেল ছোঁড়ে। এরপরই পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ায়। এরমধ্যে শহরের পুরানথানা মোড় এলাকাকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

শহরের একরামপুর মোড়, শোলাকিয়া ঈদগাহ রোড ও পুরানথানা টিনপট্টির দিকে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পুরানথানা ট্রাফিক পুলিশ বক্স-সংলগ্ন মোড়ে অবস্থান নিয়ে পুলিশ ও র‌্যাব টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থী এবং র‌্যাব-পুলিশের মধ্যে এ সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। এ সময় গুলি টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এরপরও থেকে থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল।

এছাড়া শহরের বড়বাজার তেরীপট্টি মোড়, আখড়াবাজার, নীলগঞ্জ মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় পুরানথানা রেলক্রসিং এলাকার কয়েকটি দোকান ও পুরানথানা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলি-টিয়ারশেল ও ছাত্রলীগের আক্রমণে অন্তত সাত সাংবাদিক আহত হন। তারা হলেন দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের জেলা প্রতিনিধি মো: ফারুকুজ্জামান, তার চোখে পুলিশের গুলির খোসার আঘাত লেগেছে। এতে তার চোখের ওপরে নিচে ক্ষত হয়ে যায়। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এছাড়াও আহত হয়েছেন চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের জেলা প্রতিনিধি খায়রুল আলম ফয়সাল, আজকের পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সাজন আহম্মেদ পাপন, খবরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি তাসলিমা আক্তার মিতু, যায়যায়দিনের জেলা প্রতিনিধি আশরাফ আলী, খোলা কাগজের জেলা প্রতিনিধি মেরাজ নাছিম ও কিশোগঞ্জ নিউজ-এর ভিডিও জার্নালিস্ট মো: রুবেল।

এছাড়া সংঘর্ষে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী এবং অন্তত ২০ পুলিশ সদস্য আহত হন। এদিকে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শোরাবিল হক নারিফ, নীলগঞ্জ হাজী মোমতাজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র দিদারুল ইসলাম (২২), হোসেনপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র নাঈম (২১), ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ইয়াসিন উর রহমান অমি (১৯), গুরুদয়াল সরকারি কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইফতেখার আরমান সোহান, এশিয়ান ইউনিভার্সিটির অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাফিউরসহ ১৬ জনকে গুরুতর অবস্থায় কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই হাসপাতালে দুপুর ২টা পর্যন্ত ১১ জন শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে সাত জন চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে নারিফ নামে এক শিক্ষার্থীকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও সাদাত নামে এক শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপপরিচালক) ডা. আকরাম উল্লাহ।

সংঘর্ষের সময় আহত কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের এইচএসসি’র শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার ইকরা জানান, তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাম দা ও চাইনিজ কুড়াল নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় তারা তাকেসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রী এবং ছাত্রকে কুপিয়ে আহত করেছে।

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ডান হাতে গুরুতর আঘাত পাওয়া কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শোরাবিল হক নারিফ বলেন, আমি কোনোরকম রাজনীতি করি না। আমি ছোট মানুষ। আমি আমার ছাত্র ভাইদের জন্য আন্দোলনে নামছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগের লোকেরা, যুবলীগের লোকেরা আমাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। আমাকে নির্দয়ভাবে কুপিয়ে ডান হাত প্রায় বিচ্ছিন্ন করার মতো অবস্থা করে দিয়েছে আমি সরকারের কাছে এর বিচার চাই।

এদিকে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিকে ঘিরে বিকেলেও জেলা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়কে অবস্থান ও বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। এরমধ্যে বিপুলসংখ্যক ছাত্রী এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও দেখা গেছে। জেলা শহর ছাড়াও কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরমধ্যে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়কের বিন্নাটি মোড়, জেলখানা মোড়, বড়পুল মোড় ও সাদুল্লারচরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে।

জেলার করিমগঞ্জে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ মেডিক্যাল কলেজ ও করিমগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা কমপ্লিট শাটডাউনের পক্ষে কিশোরগঞ্জ-চামড়াবন্দর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কিশোরগঞ্জগামী কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি জেলার বাজিতপুর রেলস্টেশনে প্রায় ৩০ মিনিট আটকে রাখে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এছাড়া জেলার নিকলী, করিমগঞ্জ, কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় কমপ্লিট শাটডাউনের পক্ষে বিক্ষোভ হয়েছে।

কিশোরগঞ্জে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement