১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
ছাত্রলীগের পাহারায় আসে ট্রাক

ভারতীয় চোরাই চিনিতে কিশোরগঞ্জের বাজার সয়লাব

ভারতীয় চোরাই চিনিতে কিশোরগঞ্জের বাজার সয়লাব - ছবি : নয়া দিগন্ত

শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাইপথে আসা ভারতীয় চিনিতে সয়লাব পুরো কিশোরগঞ্জ। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, জেলা শহর থেকে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের বাজার এবং গ্রামের সাধারণ দোকানেও এসব চিনি ছাড়া অন্য কোনো চিনি মিলছে না।

জেলা শহরের পাইকারি বাজার বড়বাজারেই দৈনিক এক থেকে দেড় কোটি টাকার চোরাই চিনি কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।

করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর, মরিচখালী ও পাকুন্দিয়ার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় দেশীয় পরিশোধিত চিনি ক্রেতারা খুঁজেও পাচ্ছেন না।

অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন পথে চোরাই চিনি ট্রাকে করে প্রথমে জেলা শহরে প্রবেশ করাচ্ছে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক কয়েক নেতা।

এরপর এসব চিনির বস্তা পাল্টিয়ে দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের স্টিকারযুক্ত বস্তায় ভরে এগুলো যাচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে এমনকি পাশের জেলাগুলোতেও।

গত শুক্রবার চোরাই চিনির এমনই একটি চালান পাইকারি বাজারে পৌঁছে দিতে কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন ও তার কর্মীরা সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্রাকে চিনি ছিল ২৩০ বস্তা। কেজিতে ১১ হাজার ৫০০ কেজি। পরে ওই ট্রাকটি পুলিশ আটক করে। মামলা হয় ট্রাকের চালক ও হেল্পারসহ সাধারণ কয়েকজনের নামে। ট্রাকটি আটক করা হয় শহরের নগুয়া এলাকার তালতলা থেকে। এ নিয়ে জেলা ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন।

জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান নয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মোল্লা সুমনকে উদ্দেশ্য করে একটি পোস্ট শেয়ার করে লিখেছেন,‘কিশোরগঞ্জে ভারতীয় চোরাই চিনির ব্যবসা করে কে, আর মামলা হয় কার নামে! এই ক্ষমতার খেলা আর বেশি দিন দেখাইতে পারবেন না জনাব।'

জেলা ছাত্রলীগের সাবেক গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শাওন নিলয় এক পোস্টে লিখেন,‘কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন। ... ইদানীং ভারতীয় চিনি চোরাচালানের রমরমা বাণিজ্য করে আসছে। ... ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি চরম সঙ্কট।...'

শহরের মানুষের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যও এ চোরাচালান চক্রের সাথে যুক্ত। তাদের নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া চোরাচালানের চিনি কয়েকটি উপজেলা পার হয়ে জেলা শহরের বড়বাজার পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়।

ভারতীয় চিনির বিষয়ে কথা হয় জেলা বাজার কর্মকর্তা শিখা বেগমের সাথে, তিনি বলেন, ‘ভারতীয় চিনিগুলো খুব নিম্নমানের। এগুলো খেলে মানুষ অসুখ-বিসুখে পড়বে। চিনিগুলো যেন বাজার থেকে সরানো যায় এ ব্যাপারে আমরা তৎপর হচ্ছি।'

ছাত্রলীগের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, আগে পুলিশ সদস্যদের ‘ম্যানেজ করে' সড়কপথে ভৈরব ও নান্দাইল দিয়ে এবং নৌপথে চামড়া বন্দর দিয়ে ভারতীয় চিনি জেলা শহরে আসা হতো। তখন খুব কম সংখ্যক চিনি আসতো। ছয় মাস ধরে ছাত্রলীগের কয়েকটি পক্ষ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত দিয়ে চিনির ট্রাক ভৈরব-কিশোরগঞ্জ সড়ক দিয়ে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী মোটরসাইকেলের পাহারায় এসব ট্রাক বড় বাজারে নিয়ে আসে। একইভাবে নেত্রকোনা থেকে নান্দাইল দিয়ে আসা চোরাই চিনির ট্রাকগুলোর কিছু পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর ও কিছু গাইটাল এলাকা হয়ে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী পাহারা বসিয়ে বড় বাজারে নিয়ে আসেন।

আর এই কাজে নেতৃত্বে দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য
এস এম তৌফিকুল হাসান সাগর ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিমন ঢালী।

এ ব্যাপারে মোল্লা সুমন নয়া দিগন্তকে বলেন,‘আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না ভাই। তোরাই চিনির ট্রাক আটক হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি মামলাও হয়েছে। চোরাইয়ে আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম তাহলে তো আমার নামও থাকতো। আমাকে কি কেউ সরাসরি পেয়েছে? সিসি ক্যামেরায় পেয়েছে? আমার বিরুদ্ধে বদনাম তুলছে।'

লিমন ঢালী বলেন, ‘এই শহরে কিছু ঘটলে আমার নাম উঠে, আমি রাজনীতি করি বলেই আমার শত্রু আছে, শত্রুরা এসব বলে। মনে করেন ভাই অনেকেই চোরাচালানি করে, কেউ যদি বিপদে পইড়া আমার কাছে আসে, আমি যদি দেন-দরবার কইরা দেই, ছোট্ট একটা শহর, সবাই পরিচিত, এর জন্য কি সম্পূর্ণ দোষ আমার?'

1 (3)

চিনি আসে যে পথে
সীমান্ত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবং কিশোরগঞ্জ জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য জানান,
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত থেকে চিনিবোঝাই ট্রাক ভৈরব, এগারসিন্দুর, হোসেন্দী, নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে কেন্দুয়া হয়ে নান্দাইল দিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে এসে প্রবেশ করে। সিলেট সুনামগঞ্জ শ্রীমন্ত দিয়ে আসা চিনিগুলো করিমগঞ্জের চামড়া বন্দর হয়ে জেলা শহরে আসে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চারটি উপজেলার ছয়-সাতটি রুট দিয়ে চোরাই পণ্য ঢুকছে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে। সবচেয়ে বেশি চিনি আসে চামড়া বন্দর দিয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের কিছু ব্যবসায়ী ও বাসিন্দার সাথে বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা যোগাযোগ করে এ চিনিগুলো আনছেন। পরে ছাত্রলীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতা নেয়া হয়।

যেভাবে চিনি বেচাকেনা হয়
সীমান্তবর্তী এলাকার দুইজন বাসিন্দা ও চার পাঁচজন চোরাকারবারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট সুনামগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চোরাকারবারিরা নৌকায় ও ট্রাকে পাচারের চিনি কিশোরগঞ্জের কাছাকাছি নিয়ে আসে। পরের দায়িত্ব কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর কয়েক সদস্যের।

বড়বাজারে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ টি ট্রাক আসে। একেকটি ট্রাকে গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ বস্তা চিনি থাকে। সে হিসাবে কমবেশি দেড় থেকে দুই হাজার বস্তা ভারতীয় চিনি এখানে বেচাকেনা হয়। এর বাইরে শহরের কাচারিবাজার, পাকুন্দিয়া বাজারেও প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বস্তা চোরাই চিনি এখানে আনা হয়।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতি বস্তা ভারতীয় চিনি ৫ হাজার টাকায় কেনেন। সে হিসাবে প্রতিদিন এক থেকে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা চোরাচালানের চিনি কেনাবেচা হয়। পরে তা বাজারদরে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন, যা আবার চলে যায় জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আশপাশের জেলায়।

বড়বাজার এলাকার কয়েকজন চিনি ব্যবসায়ী জানান, দেশীয় ও আমদানির চিনি প্রতি ৫০ কেজির বস্তা তাঁরা ৬ হাজার ১০০ টাকায় কেনেন এবং তা পাইকারি দরে বিক্রি করেন ৬ হাজার ১৫০ টাকায়। অন্যদিকে চোরাচালানে আসা ভারতীয় চিনির ৫০ কেজির বস্তা কিছু ব্যবসায়ী বর্তমানে ৫ হাজার টাকায় কেনেন।

পাইকারি দরে তারা এসব চিনি বিক্রি করেন ৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার ৭০০ টাকায়। সে হিসাবে বৈধ চিনিতে প্রতি বস্তায় লাভ হচ্ছে ৫০ টাকা, চোরাচালানের চিনিতে প্রতি বস্তায় লাভ হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।

বড়বাজার এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চোরাচালান হয়ে আসা ভারতীয় চিনির কারণে কিশোরগঞ্জে বৈধ চিনির আমদানি অনেকটাই কমে গেছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

আরেক ব্যবসায়ী জানান, কালোবাজারে আসা মানহীন এসব চিনি বাজারজাত হওয়ায় কিশোরগঞ্জে ১৫ দিনের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে পরিশোধিত প্রতি মণ চিনির দাম কমেছে ২শ টাকার মতো। তবে খুচরা বাজারে এর প্রভাব নেই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চোরাইপথে আসা ভারতীয় চিনি মানহীন। কালোবাজারের মানহীন এসব চিনির কারণে মার খাচ্ছে দেশী শিল্পে পরিশোধিত চিনির বাজার। আবার সরকার বড় অংকের রাজস্ব হারালেও খুচরায় দাম না কমায় ভোক্তারা হচ্ছেন প্রতারিত।

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মো: রাসেল শেখ বলেন, 'চিনি চোরাচালান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে। আর কঠোর অবস্থানে আছে বলেই অভিযানে চিনি জব্দ হচ্ছে। যারা চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত থাকুক আমরা খুঁজে বের করব।'


আরো সংবাদ



premium cement