সারাদেশে যাচ্ছে দামপাড়া গ্রামের তালপাখা
- মো: আল আমিন, কিশোরগঞ্জ
- ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:২৯, আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৩০
বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি- এমন দুর্গম গ্রাম কিংবা লোডশেডিংমাখা শহুরে জীবনে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয় হাতপাখা। তালপাতার তৈরি হাতপাখার সাথে জড়িয়ে আছে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের প্রায় দুই শ’ পরিবারের জীবন-জীবিকা।
দামপাড়া গ্রামের হাতপাখা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
প্রতিবছরের চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে তালপাখার চাহিদা বেড়ে যায়। তখন নিকলীর দামপাড়া গ্রামের নোয়ারহাটি, টেকপাড়া ও বর্মনপাড়ায় ঘরে ঘরে পাখা তৈরির ধুম পড়ে।
সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কারিগররা বাড়ির উঠানজুড়ে দল বেধে হাতপাখা তৈরির কাজ করেন। তবে এই তিন মাসের তালপাখার বাজারকে কেন্দ্র করে কারিগরদের ব্যস্ততা থাকে বছরের অন্য সময়ও।
এবার লোডশেডিং বেশি থাকায় এবং প্রচণ্ড গরমের কারণে তালপাখার চাহিদাও বেড়েছে। সারাদেশে যাচ্ছে দামপাড়া গ্রামের প্রাণ জুড়ানো দেহ শীতল করার এই হাতপাখা।
সোমবার যাওয়া হয় দামপাড়া গ্রামে। সেখানে এখন তালপাখা বানানোর ধুম লেগেছে। ছেলে, বুড়ো, কিশোর, কিশোরী, বসে নেই কেউ। ঘরের বউ-ঝিয়েরা তালের পাতাগুলো দা দিয়ে ফালি করে বেতি করছেন। এগুলো বুনন করে কেউ ছাঁটাই আকৃতি করে নিচ্ছেন। কেউ মোড়ল বাঁশ কেটে, ছেঁটে হাতল তৈরি করে দিচ্ছেন। কেউ প্লাস্টিকের বেত ও সুতা দিয়ে জালি বেতের সাথে ছাঁটাই বা ছাঁচ সেলাই করে হাতপাকার আকৃতি দিচ্ছেন। কেউ বসেছেন রংয়ের তুলি নিয়ে। আর এই কাজগুলো করা হচ্ছে দল বেধে। ঘরের বারান্দায় কিংবা বাড়ির উঠানে গাছের ছায়ায় বসে।
কথা হয় গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক নারী আশুলতা রায়ের (৮০) সাথে।
তিনি জানান, ৬০ থেকে ৭০ বছর ধরে এ গ্রামে তালপাখা তৈরি হচ্ছে। ১২ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। শাশুড়ির হাত ধরে তিনি তালপাখা তৈরির কাজ শেখেন।
আঞ্চলিক ভাষায় আশুলতা বলেন, ‘গ্রামে পর্থম আমরার এই ঘরে (নিজদের ঘর দেখিয়ে) আমার শাশুড়ি তালপাখা বানাইত। শাশুড়ির কাছ থেকে আমি শিখছি। আমার কাছ থেকে পরে গ্রামের এ, হে, সবাই শিখছে। এহন আমার বয়স অইছে, পারি না। আমার বউয়াইনে এবং নাতি-নাতকররা এহন তালপাখা বানায়।’
গ্রামের ভানুমতি সূত্রধর (৭৮) বলেন, ‘৫০ থেকে ৬০ বছর ধইরা অইবো আমরা হাতপাখা তৈরির কাজ করতাছি। ৭১ সালে এই গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। তহন আমাদের অনেকের স্বামীরে মাইরা ফালায়। আমরা বিপদে পইরা যাই। তহন কী কইরা চলবাম। এই কাজ কইরাই আমরা সংসার চালায়া আইতাছি। এহন আমার পুতের বউ, নাতিরাও এই কাজ করে।’
তালপাখা যেভাবে বানানো হয়
কাছ থেকে তালপাতা এনে শুকিয়ে নির্দিষ্ট মাপে কেটে নিতে হয়। এরপর বেতির মতো করে এগুলো দিয়ে বুনন করে ছাঁচ তৈরি করা হয়। চক্রাকার ছাঁচের চারদিকে জালি বেত ঘুরিয়ে এর ওপর প্লাস্টিকের রিবন পেঁচানো হয়। পাখার হাতল বানানো হয় মোড়ল বাঁশ কেটে ফালি করে। এরপর সেলাই করা হয় নাইলন সুতা দিয়ে। হাতলে প্লাস্টিকের সরু পাইপ কেটে চুঙ্গি দেয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় হাতপাখা।
গ্রামের বিধবা বেদনা রানী সুত্রধর বলেন, ‘এই হাত পাংখার কাজ কইরাই আমরার সংসার চলে। অনেকেই আগের থেকে এই কাজ করতাছে, আমি ৫০ বছর ধইরা করতাছি। মনে করুইন পাংখার কাজ কইরা কোনোরহম চলতাছি। এক মেয়ে বিয়া দিছি। দুই মেয়ে ঘরঅ আছে। এদের নিয়া ভালোই আছি।’
গ্রামে তালপাখা তৈরির কাজটা করেন মূলত নারীরাই। পুরুষেরা শুধু সরঞ্জাম এনে দেন। বাড়ির শিশুরা উঠানে বসে নারীদের হাতপাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে।
পাকিস্তান আমল থেকে এখানকার কারিগররা হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা চালাচ্ছেন। তিন পুরুষ ধরে এ পেশায় সংসার চালাচ্ছেন গ্রামবাসী। বংশপরম্পরায় এ গ্রামে এখনো কিশোর-তরুণ বয়সীরা পাখা তৈরির পেশা বেছে নিচ্ছে।
দামপাড়া গ্রামের বর্মনপাড়ায় দেখা যায়, বড়দের পাশাপাশি অনেক শিশুও তালপাখা তৈরির কাজ করছে।
স্থানীয় বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণী শিক্ষার্থী অঙ্কিতা বর্মন (৯) বলে, ‘পড়ালেখার ফাঁকে মা-বাবাকে আমরা তালপাখা বানানোর কাজে সহযোগিতা করি। এতে আয় হয়। খাতা কলম কিনে দেয় বাবা।’
গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা আশুলতা রায়সহ বয়স্ক অনেকেই জানান, বাংলাদেশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই দামপাড়া গ্রামে তালপাখা বানানো শুরু হয়। বাড়িতে শখের বসে আশুলতার শাশুড়ি (পরলোকগত) হেমলতা রায় প্রথমে তালের পাতা দিয়ে পাখা বানানো শুরু করেছিলেন। বাড়ির অতিথি সেবায় এই তালপাখা ব্যবহার করা হতো। তার কাছ থেকেই গ্রামের অন্যরা তালপাখা বানানো শেখে। বর্তমানে গ্রামের ২০০ পরিবারের প্রায় এক হাজার মানুষ এই তালপাখা তৈরির কাজে জড়িত।
গ্রামের তালপাখার কারিগর লিপি রায় (৪০) জানান, তিনি তার শাশুড়ির কাছ থেকে পাখা বানানোর কাজ শেখেন। তাদের পরিবারের এটাই এখন একমাত্র পেশা।
গ্রামের প্রবীণ কারিগররা জানান, স্বাধীনতার আগে একটি পাখা তৈরিতে খরচ হতো আট আনা। বিক্রি হতো এক থেকে দেড় টাকায়। এখন একটি পাখা তৈরিতে গড়ে খরচ পড়ে ৫০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা টাকায়।
কারিগর বিমলা সূত্রধর (৪৫) বলেন, ‘একটা পাংখা তৈরি করতে ৫০ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৭০ টাকা। পাংখা বিক্রি করতে বাজারে নেয়া লাগে না। পাইকাররা বাড়িত থেকে আইসাই নিয়া যায়।’
কারিগরেরা জানান, এক সময় গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন গরমে হাতপাখাই ছিল গ্রামের মানুষের ভরসা। এখন বিদ্যুৎ-জেনারেটর-আইপিএসসহ নানা যান্ত্রিকতার দাপট বেড়েছে। তবে কমেনি হাতপাখার কদর। এখনো গ্রাম-শহর দুই জায়গাতেই হাতপাখার বাজার রয়েছে। এই বাজার ধরে রাখতে এখন হাতপাখায় নানান রঙের নকশা ও জরি ব্যবহার করা হয়।
পাখার কারিগর মনসা বর্মন (৪২) বলেন, ‘একটা পাংখা বানাইতে প্লাস্টিক লাগে, জালি বেত লাগে, তালপাতা লাগে, এরপরে বাঁশ লাগে, চুঙ্গি লাগে। এসব দিয়ে তৈরি করতে হয়। সবশেষে রং দেওন লাগে। রং না দিলে বেশি সুন্দর হয় না তাই বেশি চলে না।’
তালপাখার কারিগর অলকা রায় বলেন, ‘আমরার গ্রামে এই পেশায় ২০০ পরিবার জড়িত। আমরার অন্য কোনো পেশা নেই। অন্য কোনো কাজ পারিও না। বাপ-দাদার এই পেশাটাই আমরা ধইরা রাখছি। পাংখা বানানোর জিনিসপত্রের দাম এহন অনেক বাইড়া গেছে। এগুলো জোগাড় করতে অনেকেই ঋণগ্রস্ত। সরকার যদি সুদ ছাড়া আমরারে ঋণ দিত তাইলে অনেক উপকার হইত।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা