কষ্টে দিন কাটছে চাঁই-বুচনার কারিগরদের
- হাসান মাহমুদ রিপন, সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ)
- ২৭ জুন ২০২০, ১৪:৪৯, আপডেট: ২৭ জুন ২০২০, ১৪:৫৪
ভালো নেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের চাঁই-বুচনার কারিগররা। এখন খাল-বিলে আগের মতো মাছ মেলে না। তার ওপরে এ বছর পানি দেরিতে এসেছে, মাছ আরো কম। যে কারণে কমে গছে চাঁই-বুচনার চাহিদাও। যারা সারা বছর বর্ষা মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে চাঁই-বুচনা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করবে, এ বছর তারা হতাশ। এবার মহামারি করোনায় এসব নিম্ন আয়ের মানুষগুলো চরম অভাবে দিন কাটাচ্ছেন।
জানা যায়, সোনারগাঁও পৌরসভার সাহাপুর ও বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়নের সাতভাইয়া পাড়া ও রামগঞ্জ গ্রামের শতাধিক পরিবার চাঁই-বুচনা তৈরির পেশায় জড়িত। সারা বছর চাঁই তৈরি করা হলেও বর্ষা মৌসুমে চাঁইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। সোনারগাঁওয়ের চাঁই শুধু সোনারগাঁওয়েই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন চাঁই কারিগরা। তাদের উপার্জনের একমাত্র পথ চাঁই তৈরি করা। কারিগররা অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বাঁশসহ চাঁই-বুচনা তৈরির উপকরণ কিনেন।
এদিকে এ পেশায় তেমন কোনো আয় না থাকলেও তা আঁকড়ে ধরে খুশি পরিবারগুলো। এ পেশাকে কেউ কেউ শিল্পও বলে থাকেন। এ পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশায় গেলেও ওই পরিবারগুলো বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে যাননি। এ শিল্পে বেশিরভাগ কারিগরই হলো নারী। সংসার সামলিয়ে ঘরে বসে এ কাজের মাধ্যমে তারা বাড়তি আয় করে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ভূমিকা পালন করছেন। এ ছাড়াও স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও মা-বাবাকে এ শিল্পে সহযোগিতা করছে। চাঁই তৈরির সময় চুলায় ভাত বসিয়ে নারীরা কাজ করেন। কিন্তু এ বছর করোনায় তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। করোনায় তাদের চাঁই বিক্রি বন্ধ। খুব কষ্টে দিন কাটছে তাদের। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছেন। অনেকে কীভাবে মহাজনদের দাদন পরিশোধ করবেন আর কীভাবে সারা বছর খেয়ে পরে বেঁচে থাকবেন এমন চিন্তায় মগ্ন। তার ওপরে দুর্যোগ করোনার হানায় চলছে অভাবের সংসার।
অনাথ দাস, হরে কৃষ্ণ সরকার, সনদ সরকার, রণজিৎ সরকার, জোকেশ দাস, মরন দাস- এরা সবাই চাঁই তৈরির কারিগর। সবার বাড়ি উপজেলার সোনারগাঁও পৌরসভার সাহাপুর, বৈদ্যেরবাজার ইউনিয়নের সাতভাইয়া পাড়া ও রামগঞ্জের বাসিন্দা। তারা জানালেন তাদের কষ্টের জীবনযাপনের কথা।
এ তিন গ্রামের শতাধিক পরিবার চিংড়ির চাঁই তৈরি করে উপার্জন করছে। সারা বছর এ চাঁইয়ের চাহিদা থাকায় তাদের সবসময় কাজ করতে হয়। তবে বর্ষার সময় একটু চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু এবার বর্ষায় তাদের মাথায় হাত। করোনায় বিক্রি নেই।
সোনারগাঁও পৌরসভার সাহাপুর গ্রামের চাঁই তৈরির কারিগর সনদ সরকার জানান, রকাই জাতের মুলি বাঁশ দিয়ে চাঁই তৈরি করা হয়। এ বাঁশ চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে আনা হয়। একটি মুলি বাঁশ দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরার চারটি চাঁই হয়। এ গ্রামে চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছ ধরার জন্য চার ধরনের চাঁই তৈরি করা হয়।
চাঁই বানানোর প্রধান কাঁচামাল হলো বাঁশ ও সুতা। বিভিন্ন মাপে বাঁশের শলা কেটে রোদে শুকিয়ে তার পর শুরু হয় চাঁই তৈরির কাজ। সোনারগাঁওয়ের আনন্দদবাজার ও কাইকারটেক হাটে জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা চাঁই কিনতে আসেন। কিন্তু এ বছর তাদের চাঁই বিক্রি নেই। করোনার জন্য কোনো জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা চাঁই কিনতে আসে না। তাদের সংসার চলছে না। সরকারী সহযোগিতাও পাচ্ছেন না।
সাতভাইয়া পাড়ার রণজিৎ সরকার, জোকেশ দাস, মরন দাসসহ অন্যান্য কারিগররা জানান, তাদের অনেকেই এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। অনেকে মহাজনের কাজ থেকে দাদন নিয়ে চাঁই তৈরির সরঞ্জামাদি কিনেছেন। কিন্তু চাঁই বিক্রি না হওয়ায় তারা হতাশ।
চাঁইয়ের কারিগর করবী রানী সরকার জানান, বর্তমানে চাঁই তৈরির কাজে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি। ফলে সংসারে সচ্ছলতায় ভূমিকার রাখছেন নারীরা। পুরো বছরই এ গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার চাঁই বানিয়ে থাকে। পুরুষের পাশাপাশি নারী ও স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীও এ কাজে সহযোগিতা করে।
চাঁই তৈরির কারিগর বানু সরকার ও মনোরঞ্জন দাস জানান, অন্যান্য মাছের চাঁইয়ের চেয়ে চিড়িং মাছের চাঁইয়ের চাহিদা বেশি। সোনারগাঁও ছাড়াও পটুয়াখালী, ফরিদপুর, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর জেলার মানুষ অর্ডার দিয়ে এখানে চাঁই কিনতে আসেন। কিন্তু এ বছর এ মৌসুমে কোনো অর্ডার বা বেচা বিক্রি নাই। তবে তারা বলছেন করোনা যদি শেষ হয় তাহলে আমরা আশার মুখ দেখবো। আমরা এখন কষ্টে দিন কেটে চাঁই তৈরি করে জমাট করছি।
বৈদ্যেরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সূচনা রানী জানান, মা-বাবাকে সহযোগিতার জন্য সে চাঁই তৈরির কাজ করে। এখন করোনায় স্কুল বন্ধ থাকসয় তার মা-বাবাকে এ কাজে বেশি সহযোগিতা করতে পারছে।
কারিগররা আরো জানান, কয়েক বছর আগেও বর্ষাকালে নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যেত। পানিতে ভেসে বেড়াত হরেক রকমের মাছ। এসব মাছ শিকার করার জন্য চলাচলের পথে চাঁই বা বুচনা পেতে রাখা হতো। কিন্তু এখন মাছ না থাকায় চাঁই-বুচনা পেতে মাছ শিকার করার আগ্রহ কমে গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খালে-বিলে পানি ও মাছ না থাকায় বাজারে এখন চাঁই-বুচনার চাহিদা এবং দাম দুটিই কম। আগে বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই হাট-বাজারগুলোতে চাঁই-বুচনা কেনার ধুম পড়ে যেত। এখন তা আর চোখে পড়ছে না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা