২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
১৫ লক্ষ শ্রমিক চাকুরী হারানো ঝুঁকিতে

গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে অজানা শংকায় ব্যবসায়ীরা 

গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে অজানা শংকায় ব্যবসায়ীরা  - সংগৃহীত

করোনা দুর্যোগে দেশের গার্মেন্ট শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছে এখাতের উদ্যোক্তরা। দূর্যোগের কারণে এখাতে কতো আর্থিক লোকসানের মাধ্যমে এই শিল্পের উত্তরণ হবে। তা কারো জানা নেই। তবে ইতোমধ্যে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। এই সাথে শ্রমিক কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন, বিদ্যুৎ গ্যাস, ব্যাংকের সুদ আরো দুই বিলিয়ন পর্যন্ত লোকসান হবে। সব মিলিয়ে ছয় বিলিয়ন ডলার লোকসান হবে। নয়াদিগন্তকে এমন শংকার কথা জানিয়েছেন গার্মেন্টস শিল্পের একজন উদ্যোক্তা,নীট গার্মেন্ট ব্যবসায়িদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ক্রোনি গ্রুপের এমডি এ এইচ আসলাম সানি।

করোনা বিপর্যয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে সাবেক এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আজ কল্পনাও করতে পারছি না। ৪০ বছরে গড়ে উঠা এই শিল্পের সঙ্গে মালিক কর্মচারী শ্রমিক সবার ভবিষৎ। শুধু গার্মেন্ট শিল্পের বিপর্যই নয়। এর সাথে জড়িত বাংক, বিমা, হোটেল, ট্রান্সপোর্ট সব ব্যবসাই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।

আসলাম সানি বলেন, আজ ইউরোপ আমেরিকা সমস্ত স্টোর এবং শপিংমলগুলো বন্ধ। তাদের ২ মাসের বেশী বন্ধ থাকলে পরবর্তী সিজনের চার মাস এই অবস্থা থাকবে। বিক্রি করতে পারবে না। সেই সাথে নতুন কোনো অর্ডারও সাপ্লাই চেইনে নাই। একদিকে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্ডার স্টক, নতুন কোনো অর্ডার সাপ্লাই চেইনে নাই। তাইতো ৯৫ শতাংশ বায়ারের ক্যাশ ফ্লো বন্ধ হয়ে যাবে। আমার ধারণা ৪০ শতাংশ বায়ার আর্থিক সংকট কাটাইয়া উঠতে পারবে না এবং তারা তাদের দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ করে দিবে।

তিনি জানান, সমস্ত সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হওয়ায় জন্য ৫০ শতাংশ যুব সমাজ চাকুরী হারাবে। তারজন্য ইউরোপ আমেরিকায় ৩০/৪০ শতাংশ অর্ডার কমে যাবে। একই সাথে চাহিদা কমে যাওয়া ও রপ্তানি আমদানি কারক দেশগুলোর অর্থনৈতিক সখ্যতা কমে যাওয়ায় তৈরী পোষাকের চাহিদা ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

সে হিসেবে আমাদের ১৫ লক্ষ শ্রমিক চাকুরী হারানো ঝুঁকিতে আছে। শুধু শ্রমিকই নয় বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে ৫০ শতাংশ আছে যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের কথা কেউ বলে না। তারা ইন্ডাটিস্ট্রয়াল ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত মার্চেনডাইজার, প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ার, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং টেক্সটাইল এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। এই পাঁচলক্ষ শিক্ষিত যুবকদের বেতন ৫’শ ডলার থেকে ৮ হাজার ডলার। এই শিক্ষিত তরুনদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেকার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বিকেএমইএর সাবেক এ নেতা জানান, আজ যখন অনেক মালিক মহামারি পরিস্থতিতে আইন মেনে লে অফ ঘোষণা করছে। তখন শ্রমিক নামী অনেক নেতা, যারা কোনো দিন শ্রমিক হিসেবে কোনো কারখানায় কাজ করেনি। তারাই মালিকেদের বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা করছে। অনেকে বলছে শ্রমিক ছাটাই বে আইনি। একটু ভেবে দেখুন একটি কারাখানায় যখন তিন মাসের উৎদাপন অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। যা দুই বছরের বেতনের সমান, তাহলে মালিকের কতটাকা জমানো আছে, সেই মালিক বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে পারবেন। আইন যদি তারা সমভাবে বে আইননি বলে তাহলে মালিক হওয়া কি অপরাধ? তাহলে মালিকরা কি মানুষ না ?

আসলাম সানি জানান, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন লকডাউন কখনও হয়েছে কিনা কারো জানা নেই। বাংলাদেশ আজ এক মাসের বেশী সময় ধরে সমস্ত কিছু বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে ১৬ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সকল পেশার মানুষ উদ্বিগ্ন আমি গার্মেন্ট শিল্পের একজন উদ্যেক্তা হিসেবে যেমন ভাবে চিন্তিত, আমার ৩০ বছরের কষ্টের সমস্ত উপার্জন রি-ইনভেস্ট করে যখন ১৫ হাজার শ্রমিক এবং এক হাজার শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান তৈরী করেছি। তাদের জন্য ভিষণভাবে উদ্বিগ্ন। এই ৩০ বছর যা উপার্যন করেছি। তার ৯৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে তিলে তিলে গড়া হাজার কোটি টাকার শিল্প আজ শুধুই সুন্দর অট্টালিকা ছাড়া কিছুই না। শুধু আমিই না আমার মতো প্রথম প্রজন্মের গার্মেন্ট শিল্প একই ভাবে বিকশিত হয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়ির সকলের আত্মত্যাগেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশ। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সব সময় অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়েছে আমাদের।

তিনি জানান, চীন ও ভারতের ব্যবসায়ীদের যেমন কমপ্লায়েন্সের যাতাকলে পরতে হয় না। তার পরেও এই ৪০ বছরে অনেক প্রতিকূলতায় পার হয়ে গার্মেন্ট শিল্প বিকশিত হয়েছে। এখানে ১৯৯৬ জিএসসি সমস্যা, ১৯৯৮ বন্যা, ২০০১ ডিউটি কোটা ফ্রি, ২০০৮ ও ২০০৯ বিশ্ব মন্দা, ২০১১-১৪ রাজনৈতিক সহিংসতায় যখন এক ট্রাক শিপমেন্টে এক লাখ টাকার বেশী খচর হয়েছে। তার পরেও আমরা ১০ শতাংশের বেশী প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছি।

২০১৪ সালে অবরোধের সময় ৪০ শতাংশের বেশি এয়ার শিপমেন্ট করে আমাদের বায়ারদের অনটাইম নিশ্চিত রেখেছি। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের শিল্পের মালিকরা কোনো প্রণোদনা পায়নি বা প্রণোদনা চায় না। (নতুন বাজার তৈরীর প্রণোদনা ছাড়া)। সবারই একই উদ্যেশ ছিল বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানো। সবাই বড় বড় ফ্যাক্টরি করেছে। ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করে এক একটি কারখানায়। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর মেডি ইন বাংলাদেশ যখন রক্তমাথা শাট ছিল সমস্ত বিশ্বের কাছে, যে ধ্বংসস্তুপ থেকে কোনো প্রনোদনা ছাড়া তিন বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে বায়ারদের সন্তুষ্টির জন্য ফায়ার এন্ড ইলেকট্রিক সেফটি বিল্ডিং আজ বিশ্বের কাছে উদাহরণ। খুব মজার কথা হলো কোনো বিদেশি বায়ার কিংবা সরকার আমাদের এই বিনিয়োগে সামিল হয়নি।

এখানে উল্লেখ করতে চাই শুধু ফায়ার সেফটি ইকুপমেন্ট শুল্ক ৫ শতাংশ রাখতে দুই বছরের বেশী সময় লেগেছে। এখন প্রশ্ন এই ৪০ বছরে এতো গুলো বিপর্যয় কিভাবে সামাল দিল গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা।

আমি কারো নাম উল্লেখ না করে বলতে চাই যাদের হাত ধরে এদেশে গার্মেন্ট শিল্প গড়ে উঠেছিল, তাদের আজ ৯০ শতাংশ ব্যক্তিগত ভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কেন মানুষ এ ব্যবসা করে? কারণ এই ব্যবসা থেকে বের হওয়ার আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেই।

তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্য দেয়া ভাষণে সত্যিই বলেছেন, অন্ধকারের পরেই আলো। কিন্তু যে অন্ধকারে আজ গোটা পৃথিবী নিমর্জিত। এই উত্তরণ দরকার সব মানুষের জন সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। যাতে নতুন করে নতুন ভাবে সবাই সবকিছু গড়ে তুলতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement