২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এক ইতালি প্রবাসীর ঘরেফেরা ও শিবচরের লকডাউনের কাহিনী

এক ইতালি প্রবাসীর ঘরেফেরা ও শিবচরের লকডাউনের কাহিনী - সংগৃহীত

দেশের প্রথম লকডাউন হওয়া উপজেলা মাদারীপুরের শিবচর। আট দিন যাবৎ এ উপজেলা অবরুদ্ধ। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী এই উপজেলাতেই। আর এই উপজেলার আটজন রোগী সংক্রমিত হয় শিবচরের এক ইতালি প্রবাসীর দেশে ফেরার মাধ্যমে।

গত ৭ মার্চ ২০২০। তখনো বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলেনি। ওই দিন বাংলাদেশে আসেন শিবচর পৌর এলাকার এক ইতালি প্রবাসী। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের কোনো সংবাদ পাওয়া না গেলেও ইতালিতে ওই সময় মহামারী চলছে। বাংলাদেশে পৌঁছার পর থেকেই তিনি জ্বর, কাশি ও গলা ব্যথা অনুভব করেন। চিকিৎসা নিতে প্রথমেই শরণাপন্ন হোন স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ওই চিকিৎসক তাকে ঢাকায় চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেন। ঢাকা মেডিক্যালের চিকিৎসকরা তার ইতিহাস ও উপসর্গ বিশ্লেষণ করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে সন্দেহ করেন। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আইইডিসিআরে পরীক্ষা করলে তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ হন। এরপর আইইডিসিআরের প্রতিনিধিদল মাঠে নেমে ওই করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা মানুষের তালিকা প্রস্তুত করে ব্যবস্থা নেয়। আইইডিসিআরের পরীক্ষায় একে একে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয় তার স্ত্রী, ছয় বছর ও দুই বছর বয়সী দুই শিশুসন্তান, বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালকের স্ত্রী, চিকিৎসক ও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আইইডিসিআরের পরামর্শ অনুযায়ী আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা মানুষকে হোম কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়। হোম কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয় তার ছয় বছরের মেয়ের স্কুলের ১৯ সহপাঠীকেও। ইতালি প্রবাসীর মেয়ে গত ১১ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাসে যায়। ওই ক্লাসে সেদিন ১৯ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। আইইডিসিআর যেদিন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে জেলা ওয়ারী করোনা রোগীর তালিকা প্রকাশ করেন সেদিন ঢাকা জেলার পরেই ছিল মাদারীপুরের অবস্থান। এর মধ্যে জেলার তালিকায় শিবচর উপজেলায় ৯ জন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংবাদ সম্মেলনে মাদারীপুর, ফরিদপুর ও শিবচর প্রয়োজনে লকডাউন করা কথা বলেন।

গত ১২ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে চিহ্নিত এলাকাগুলো জনসমাগম এড়াতে শিবচর উপজেলা প্রশাসন কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথম অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপাট খোলা রেখে এবং ধরনের দোকানপাট বন্ধ এবং গণপরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরই প্রশাসন আবার সেই সিদ্ধান্ত কিছুটা শিথিল করে। তবে থেমে থাকেনি দেশের প্রচারমাধ্যম। উপজেলা প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্তের পরপরই গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয় লকডাউন। পরের দিন ১৩ মার্চ (শুক্রবার) মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে শিবচরে আবার জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মাদারীপুর পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, আইইডিসিআররের প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিল। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নূর-ই-আলম মিনার নেতৃত্বে জেলা পুলিশও সভা করে। সেখান থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৌর এলাকার ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড, দক্ষিণ বহেরাতলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম ও পাঁচ্চর ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের কিছু স্থান।

চারটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিহ্নত করা হয়। পরের দিন থেকে চিহ্নিহ্নত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে কঠোর নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু খাবার সঙ্কটের কথা চিন্তা করে মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর নির্দেশে হোম কোয়ারেন্টিনে (ঘরবন্দী) এলাকার মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পৌঁছে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। পরের দিন থেকেই উপজেলার ১৯ ইউনিয়ন ও শিবচর পৌর এলাকার সর্বত্র হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানো শুরু করেন। এ পর্যন্ত প্রবাসী ও স্বল্প আয়ের ৮০০ পরিবারের মধ্যে ৮২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এ ছাড়া ডাল, পেঁয়াজ, তেল, আলু, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ করা হয়। এ ছাড়াও ৫৭৫ জন মৎস্যজীবী পরিবারকে ৮০ কেজি করে চাল বিতরণ এবং দরিদ্র অসহায় ২ হাজার ১৯৬ পরিবারের মধ্যে ভিজিডির ৩০ কেজি করে চাল প্রদান করা হয়। উপজেলার নিম্ন আয়ের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে এই সাহায্যের আওতায় নেয়া হয়েছে।
সেখানের আগের দিনের সিদ্ধান্ত আরো কঠিনভাবে প্রয়োগ করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে একমত হন। এটাই দেশের মধ্যে প্রথম লকডাউন করা এলাকা। বিদেশ থেকে আসা রোগীর সংস্পর্শে আসেন তার শ্বশুরবাড়ি ও নিজের পরিবার। এ ছাড়া প্রয়োজন অনুসারে কাউকে আইসোলেশনে এবং আক্রান্তদের সরকার নির্ধারিত চিকিৎসকেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গত বুধবার ২৫ মার্চ ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বাবা মারা যান।

গত ৭ মার্চ শিবচরে এসে এ পর্যন্ত এই উপজেলায় একজন প্রবাসীর পরিবারের আটজনসহ ৯জন করোনা রোগী সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে আক্রান্ত প্রবাসীর বাবা মারা গেছেন। কিন্তু ওই প্রবাসীর অবাধ চলাফেরার কারণে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে কতটুকু সংক্রমিত হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সন্দেহ। প্রবাসী করোনাভাইরাস বহন করে ভ্যানে চড়ে শিবচর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা-যাওয়া করেন। ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হলে সেখান থেকে আবার লোকাল পরিবহনে চড়েই প্রবাসী ঢাকায় যান। ঢাকায় গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় স্ত্রী ও মেয়েসহ অবস্থান করেন এবং ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নেন। সেখানেও চিকিৎসকসহ কতজন সংক্রমিত হয়েছে আসলে তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তারপরও আশার বাণী হলো- আইইডিসিআর গত দুই দিনে শিবচরে ১৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করলেও সবাই করোনা নেগেটিভ বলে জানাতে পেরেছি। উপজেলাটি এখন উন্নতির দিকে বলে তিনি দাবি করেন।

করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে সুনসান নিরবতা ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা শিবচর। গতকাল শুক্রবার এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে শিবচরের চিহ্নিত এলাকার ওই ৭০ হাজার মানুষই হোম কোয়ারেন্টিনে। শুধু তারাই নন, এলাকার সাত লাখ মানুষই স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। বাজার হাট-ঘাট সবই বন্ধ। স্থানীয় প্রতিটি ইউনিয়ন গ্রাম-পাড়া মহল্লার দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভ্যান ও অটোচালকেরা ঘরে বসে। নিম্ন আয়ের মানুষ চরম বিপাকে। কাঁচাবাজার খোলা। কিন্তু সংক্রমণ এড়াতে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না সাধারণ জনগণ।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: শাশাংক চন্দ্র ঘোষ জানান, এই উপজেলায় একজন প্রবাসীর পরিবারের আটজনসহ নয়জন করোনা রোগী সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে আক্রান্ত প্রবাসীর বাবা মারা গেছেন বলে শুনেছি। আইইডিসিআর গত দুই দিনে ১৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করলেও সবাই করোনা নেগেটিভ বলে জানতে পেরেছি। উপজেলাটি এখন উন্নতির দিকে বলে তিনি দাবি করেন।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিভাগ ও পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মিডিয়াকর্মীসহ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় করোনা ঝুঁকি এড়াতে এক যোগে কাজ করছি। মূলত উপজেলাটি সঠিক সময়ে লকডাউন ঘোষণা করার পর চিফ হুইপ স্যারের ওষুধ ও খাবার বিতরণ কর্মসূচি চালু করায় স্বল্প আয়ের মানুষ ও প্রবাসীরা আশ্বস্ত হন। তাই মানুষ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। মানুষও এখন অনেক সচেতন। এই উপজেলার দৃষ্টান্ত দেশের মানুষ মানলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে সুফল আসবে।

শিবচর পৌরমেয়র আওলাদ হোসেন খান জানান, ইতালী প্রবাসী শিবচরে এসে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যান। সেখানে তার সংস্পর্শে স্ত্রী, ছয় বছর ও দুই বছর বয়সী দুই শিশুসন্তান, বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালকের স্ত্রী, চিকিৎসক ও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার দ্বারা আক্রান্ত হন। ওই আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৫ মার্চ বুধবার ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ-মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বাবা মারা যান। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর নির্দেশে উপজেলার সর্বত্র হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসী ও স্বল্প আয়ের মানুষদের বাড়ি বাড়ি প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি।
মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডা: মো: শফিকুল ইসলাম জানান, জনৈক ইতালি প্রবাসী করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে প্রথমে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার দেখান। পরে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে আইইডিসিআরের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনিই প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বলে শনাক্ত হন।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, প্রবাসী অধ্যুষিত মাদারীপুর জেলা। এরপর আবার শিবচরের অনেক মানুষই ইতালিসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাস করেন। করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি গত ৭ মার্চ প্রথম এ দেশে প্রবেশ করেন। প্রথমে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নেন। আইইডিসিআরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বলে শনাক্ত করেন। এটাই সম্ভবত এই দেশের প্রথম শনাক্তকৃত করোনা রোগী।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এমপি করোনা সংক্রমণের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে এলাকার মানুষকে ধৈর্য ধরে ঘরে থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, হোম কোয়ারেন্টিনে (ঘরবন্দী) এলাকার মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। উপজেলার ১৯ ইউনিয়ন ও শিবচর পৌর এলাকার সর্বত্র হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসী ও নি¤œ আয়ের মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দিবো। ঘরে খাবার না থাকলে মানুষ ঘর থেকে বের হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই যাতে খাবারের জন্য ঘর থেকে বের হতে না হয়। সেজন্য ঘরবন্দী মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করেছি। মানুষ কষ্ট করে ঘরে থাকলেও অন্তত তাদের না খেয়ে থাকতে হবে না।


আরো সংবাদ



premium cement