২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাবা ফিরবে, অপেক্ষায় হোলি আর্টিজানে নিহত সাইফুলের সন্তানেরা 

৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে কষ্টে আছেন স্ত্রী
তিন সন্তানকে নিয়ে মায়ের সাথে আছেন নিহত সাইফুলের স্ত্রী - ছবি : নয়া দিগন্ত

তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো চোখের পানিতে ভাসছেন ঢাকার আভিজাত এলাকা গুলশানের হোলে আর্টিজান রেস্তোরাঁয় উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় নিহত রেস্তোরাঁটির পিজার শেফ সাইফুলের পরিবার। রেস্তোরাঁটির কর্তৃপক্ষ সাইফুলের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার জন্য মাসিক কিছু অর্থের যোগান দিলেও সংসার চলে স্ত্রী সোনিয়ার সেলাই মেশিন চালানোর আয় দিয়ে।

সাইফুল নিহত হওয়ার তিন মাস পর ভুমিষ্ট হওয়া পুত্রসন্তান এখন দৌড়াতে শিখেছে, বাবা বাবা বলে ডাকাসহ শিখেছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে অনেক কথাই। বাড়ির অন্য শিশুরা তাদের বাবার কোলে গেলে সাইফুলের দুই বছর নয় মাসের অবুঝ শিশু হাসান তখন তার বাবার ছবি নিয়ে বলে বাবা বিদেশ আছে, ঢাকা আছে, বাবা আসবে। কিন্তু এ অবুঝ শিশু কি জানে তার বাবা কোন দিনই ফিরে আসবে না। সে আর কোন দিনই তার বাবাকে দেখতে পাবে না।

এদিকে ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মা সমেরা বেগম এখন অনেকটাই চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী সোনিয়ার কান্না থামেনি ৩ বছরেও। স্বামীর কথা জানতে চাইলেই মাথা ঘুরিয়ে ঝড়াতে থাকেন চোখের পানি।

অপর দিকে, সাইফুলের ১২ বছরের কন্যা সামিয়া ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ও ইমলী (৯) চতুর্থ শ্রেণিতে পার্শ্ববর্তী মা ইন্টারন্যাশনাল কিন্ডার গার্টেনে পড়ালেখা করছে। তারা দু’জনই বুঝতে শিখেছে তাদের বাবা আর কোন দিন তাদের কাছে ফিরে আসবে না। তাদেরকে আদর সোহাগ দিবে না। স্কুলের অন্যদের মত বাবা কোন দিন স্কুলে তাদেরকে আনতে যাবে না। তবে তাদের বাবার কথা বলতেই বাকরুদ্ধ হয়ে নীরবে চোখের পানি ঝড়ায় দু’বোন সামিয়া ও ইমলী। তিন শিশু সন্তান ও শাশুড়ীকে নিয়েই সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া আকতারের ভাবনা। তিনি এখন আর পিছনে তাকাতে চান না। সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে।

তার পরেও সাইফুলের কথা জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সাইফুলের মরদেহটাও আমাদেরকে দেয়া হয়নি। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে বেওয়ারিশ লাশ বলে নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে দাফন করেছে। আমার অবুঝ শিশুটি বড় হয়ে তার বাবার কবরটাও দেখতে পাবে না। এর চাইতে আর দুঃখ কি হতে পারে? আমার স্বামী জঙ্গি অপবাদ থেকে মুক্তি পেলেও এখনো আমরা সরকারের কাছ থেকে কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সহযোগিতা কামনা করছি।

নিহত সাইফুলের পরিবার ও তার স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কলুকাঠি গ্রামের মৃত আবুল হাসেম চৌকিদারের ৫ সন্তানের মধ্যে সাইফুল ইসলাম চৌকিদার দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্টের মাঝে বড় হয়েছে সে। এর পর সাইফুল আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় জার্মাান যায়। দীর্ঘ ১০ বছর সে জার্মাানীতে থাকার পরে দেশে ফিরে। সাইফুল নিহত হওয়ার মাত্র দেড় বছর পূর্বে ঢাকার গুলশানে হোলে আর্টিজান রেস্তোরায় পিজা তৈরীর শেফ হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে তিনি ঢাকার গুলশান আভিজাত এলাকায় হোলে আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়। নিহত হওয়ার পর থেকে কর্তব্যরত পুলিশ সাইফুলকে জঙ্গি বলে চিহ্নিত করে। তদন্ত কালে সাইফুলের মা সমেরা বেগম কে সরকারের আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ছেলের লাশ সনাক্ত করতে লাশের ডিএনএ টেস্ট করতে ঢাকায় নিয়ে যায়।

এ ছাড়া ও স্থানীয় সংসদ সদস্য, নড়িয়া থানা ও পৌরসভার পক্ষ থেকেও সাইফুলের মরদেহ ফিরে পাওয়ার জন্য প্রত্যয়ন দেয়া হয়। সরকারের আইন শৃংখলা বাহিনী দীর্ঘ ৩ মাস তদন্ত করে অবশেষে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে বেওয়ারিশ লাশ বলে সাইফুলের লাশ নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে দাফন করে।

নিহত সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের স্ত্রী সোনিয়া আকতার (২৯) তার দুই কন্যা সামিয়া (১২) ইমলী আক্তার জিদনী (১০) ও ৩৩ মাসের শিশু পুত্র হাসানকে নিয়ে কোন রকম দিন কাটাচ্ছেন। বাপ হারা, ভাই হারা, স্বামী হারা সোনিয়া আজ পরনির্ভরশীল হয়ে তিনটি শিশু সন্তান ও তার শাশুড়ী সমেরা বেগমকে নিয়ে অনেক সময় অর্ধহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঘটনার ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সাহায্য সহযোগীতা। সরকারিভাবে নেয়া হয়নির কোন খোঁজ খবর।

সাইফুলের রেখে যাওয়া কন্যা সামিয়া ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আর ইমলি আক্তার জিদনী চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। সাইফুলে মায়ের বুকফাটা কান্না থামেনি এখনো। সাইফুলের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই কেঁদে বুক ভাসান তার স্ত্রী সোনিয়া। সাইফুলের লাশটা ফেরত এনে বাপ দাদার মাটিতে কবর দিতে ও পারেনি তারা। পুরো পরিবারটির অসহায় অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। সাইফুল নিহত হওয়ার সময়ে তার স্ত্রী ৭ মাসের অন্তঃসত্তা ছিলেন। নিহত হওয়ার তিন মাস পরেই অনাগত সন্তান ভুমিষ্ট হয়। জন্ম নেয় একটি ফুট ফুটে পূত্র সন্তান। শিশুটির নাম রাখা হয় হাসান।

সাইফুলের বাড়ী গিয়ে দেখা যায়, সাইফুলের শিশু পুত্র হাসান এখন হাটতে এবং দৌড়াতে শিখেছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গ কন্ঠে সবাইকেই ডাকতে শিখেছে। শিশু হাচানের ডাক শুনলে এবং সুন্দর মুখের হাসি দেখে যে কারো প্রান জুড়িয়ে যায়। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই ঘর থেকে ছবি এনে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে হাসান, খোজাখুজি করে মোবাইল ফোনে থাকা বাবার ছবি। এ যেন জনম জনমের চেনা মুখ হাসানের। বাবার ছবি দেখিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বাবা বাবা ডাকে আর বলে বাবা আসবে। বাবা বিদেশ আছে, বাবা ঢাকায় আছে, আমার জন্য মজা আনবে, জামা আনবে।

নিহত সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, সাইফুল নিহত হওয়ার দিন বিকেলে শেষ কথা হয়। বার বার সরকারের পক্ষ থেকে লাশ ফেরতে আশ্বাস দিয়েও বেওয়ারিশ লাশ বলে তাকে দাফন করা হয়। সাইফুল নিহত হওয়ার পর থেকেই আমার শাশুড়ী পুত্র শোকে অসুস্থ হয়ে যায়। তিনি এখনো সুস্থ হননি। সাইফুল নিহত হওয়ার ৩ মাস পর আমার পুত্র সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েছে। সে এখন অনেক কথাই শিখেছে, কিন্ত হাসান কখনই বুঝতে চায় না ওর বাবা আর ফিরে আসবে না। বাবার কথা মনে পড়লেই মোবাইলে ওর বাবার ছবি দেখে। ওর বাবা বাবা ডাক শুনলে আমি স্থির থাকতে পারি না। হোলি আর্টিজান কর্তৃপক্ষ ছেলে-মেয়ের লেখা পড়ার জন্য মাসিক ১০ হাজার করে টাকা দেয়। বাকী খরচ চালাতে হয় সেলাই মেশিনে কাজ করে এবং পরের উপর নির্ভর করে। আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোন সাহায্য পাইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সহযোগিতা কামনা করছি।

নিহতের মা সমেরা বেগম জানান, আমার ছেলের লাশ পাওয়ার জন্য একাধিকবার ঢাকা গিয়েছিলাম। আমার ছেলের লাশটি দেয়নি। আমার ছেলের কি অপরাধ ছিল। আমার নাতিটা তার বাবার কথা জানতে চাইলে আমি কোন উত্তর দিতে পারি না। তারপরেও মিথ্যা বলতে হয় যে তোমার বাবা বিদেশ আছে। তোমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসবে। আমি আর কতদিন এ মিথ্যার আশ্রয় নিবো আমার এ অবঝ নাতির কাছে।


আরো সংবাদ



premium cement