২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নববধূ থেকে শুরু করে জননী সবার কোলাহলে মুখর বউমেলা

নববধূ থেকে শুরু করে জননী সবার কোলাহলে মুখর বউমেলা - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রায় দুই শ' বছরের আদি বটবৃক্ষের নিচে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন ফল-ফলাদির ঝুড়ি নিয়ে পূজা অর্চনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন নববধূ থেকে শুরু করে দু’তিন সন্তানের জননীরা। তাদের সঙ্গে টুকটুকে রঙিন ফুলেল সাজে দাঁড়িয়ে সনাতনী কুমারী মেয়েরা। সবার দৃষ্টি বটবৃক্ষের দিকে। সকাল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুপুর হওয়ার আগেই চারদিকে বাড়ে সনাতন ধর্মালম্বীর অনুসারী আবাল, বৃদ্ধ, বনিতাদের কোলাহল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ভট্টপুর জয়রামপুর গ্রামের আদি বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে বউমেলার দৃশ্য এটি। এ মেলাকে সনাতন ধর্মালম্বীর অনেকে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মেলা ও বটবৃক্ষকে সিদ্ধেশরী দেবী বলে আখ্যায়িত করেন। প্রায় চার শ' বছরের পুরানো একটি বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে এ বউ মেলা। বৈশাখের ২য় দিন থেকে এ ‘বউমেলা’ শুরু হয়।

সোমবার দুপুরে সোনারগাঁও উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন জয়রামপুর এলাকায় ভট্টপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের বটতলায় শুরু হয়েছে বউ মেলা। এ মেলা এসে হিন্দু সনাতনী নারীরা এসে জড়ো হয়েছেন। তারা বটগাছের গোড়াতেই সনাতনধর্মী নারীরা এসে পুজা শুরু করেন।

স্থানীয় হিন্দু ধর্মালম্বীরা জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এ বটবৃক্ষটি হয়ে উঠেছে পূণ্যের দেবতা। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বটবৃক্ষটি সিদ্ধেশ্বরী দেবতা নামে সুপরিচিত। বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে সিদ্ধেশ্বরী কালী তলার এ বউ মেলার জন্য। এ বিশ্বাসেই এখানে বউ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে এ বউ মেলার জন্য। রেকাবি ভরা বৈশাখী ফলের ভোগ নিয়ে দলে দলে হিন্দু নারীরা হাজির হয় বউ মেলায়। পাশাপাশি দেবতার সন্তুষ্টির জন্য কবুতর উড়ানো ও পাঁঠা বলি দেয়া হয় বৃক্ষ দেবতার পদতলে। স্বামী সংসারের বাঁধন যেন অটুট থাকে সারা বছর সুখ শান্তিতে যেন কাটে দাম্পত্য জীবন এই কামনাতেই পূজার আয়োজন করে হিন্দু নারীরা।

গতকাল সোমবার সকাল থেকে অগনিত রমণীর কলহাস্য ও পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বটতলার বউমেলা। বউমেলায় অংশগ্রহনকারীদের অধিকাংশ নারী হলেও পুরুষরাও এ মেলায় অংশ গ্রহন করে তবে সংখ্যায় কম। রমণীরা হাতের রিকাবীতে তরমুজ, কাঁঠাল, কলা আম, শশা, বাঙ্গিসহ মৌসুমী ফল নিয়ে লাইন ধরে বটবৃক্ষ তলে ভোগ দিয়ে পুজা আর্চনা করেন। মৌসুমী ফলের স্তুপ পড়ে যায় বট তলায়। ফল দিয়ে পূজা-অর্চনা শেষে ভক্তবৃন্দের মধ্যে প্রসাদরূপে বিতরণ করা হয়। পহেলা বৈশাখের পরদিন সোমবার পূজার আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শুরু হয় ৩ দিনব্যাপী বউমেলা।

মেলায় পূজা অর্চনা ছাড়াও বউ মেলায় বাঙালী সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য খুজেঁ পাওয়া যায়। এ বউ মেলায় দারু ও মৃৎ শিল্পীদের তৈয়ারী নানা রংঙের নানা বর্ণের টেপা পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ময়না, টিয়া, বাঘ-ভাল্লুক, হাঁড়ি পাতিল থেকে শুরু করে মন্ড-মিঠাইয়ের দোকান বসে। বিভিন্ন মনোহারি জিনিস পত্রের পসরা নিয়ে বসে মেলায়। মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প, কাঠ ও বাশেঁর তৈরী লোক পন্য ছাড়াও মেলায় পাওয়া যায় বাহারী মিষ্টান্ন সামগ্রী। সোনারগাঁওয়ের বউমেলা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে একটি।

সনাতন ধর্মালম্বীর অনেকের মতে বউ মেলায় পূজাঁ অর্চনা করলে পুরনো বছরের স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া বিবাদকে দূরে ঠেলে দিয়ে একজন বধূ যেন স্বামী সোহাগিনী হয়ে উঠে এবং নতুন বছরে স্বামীর সংসারকে ধন ধান্যে ভরে তুলতে পারে।

এখানে অনেক ভক্তদের দেবীর নামে পাঠা ও কবুতর উৎসর্গ করতে দেখা যায়। সনাতন ধর্মালম্বী আবাল বৃদ্ধ বনিতারা তাদের মনের বাসনা পূরনের লক্ষ্যে বট মূলে পূজা অর্চনাসহ বিভিন্ন ফলমূল ও পশু পাখি ভোগ দিয়ে থাকেন। অনেকের বিশ্বাস বটমূলের মাটি শরীরের মাখলে রোগবালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রেমে সফল ও দ্রুত বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার জন্য এ স্থানের মাটি খুবই উপকারী মনে করে এই দিনটিতে সনাতন ধর্মালম্বীর লোকেরা মাটি সংগ্রহ করে থাকে। বউ মেলাকে কেন্দ্র উপজেলার জয়রামপুর, ভট্টপুর, ষোলপাড়া, পানামসহ আশে পাশের সনাতন ধর্মালম্বীর লোকজনদের মধ্যে উৎসবের আমেজে মুখরিত হয়ে উঠে।

মেলায় আসা নববধূ পৌষি দাস ও মনিকা সাহা জানান, সংসারের সুখ শান্তি ও স্বামী সন্তানের মঙ্গল কামনায় আমরা এ মেলায় এসে পুজা করতে এসেছি। বড়দের কাছ থেকে শুনেছি এ মেলায় এসে পুজা আর্চনায় স্বামী সন্তান ও সংসারের কল্যাণ কামনায় সফল হয়। তাই এসেছি এ মেলায়।
পুরোহীত চন্দন ভট্টাচার্য জানান, এ বউ মেলায় সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীরা ভীড় করে সিদ্ধেশ্বরী বটতলায়। দুপুরে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পুজা আর্চনা হয়ে মেলা শুরু হয়। এ মেলা পূজা আর্চনা মূলত একদিনে। কিন্তু মেলা জমে ৩ দিন। এ মেলাটি নারীকেন্দ্রিক হলেও এখানে আসেন হিন্দু, মুসলমান সকল ধর্মালম্বীর মানুষ। আসে বিদেশী পর্যটকরাও।

বউ মেলা আয়োজক কমিটির কর্মকর্তা নিলোৎপল রায় জানান, নব রূপে এসো নববর্ষ ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরায় ‘এসো হে বৈশাখ এসো’ নতুন বছর সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে এবারও বর্ষবরণ উৎসবে আমরা সিদ্ধেশ্বরী কলী পূজার আয়োজন করেছি। গত বছরের তুলনায় এ বছর ভক্তদের উপস্থিতি একটু বেশি। স্থানীয়দের সহায়তায় এবছর কালী মায়ের পূজার স্থানটি টাইলস বসিয়ে পাকা করা হয়েছে।

সিদ্ধেশ্বরী বটতলার পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি মানিক ঘোষ জানান, সকলের সহযোগিতায় এ বউ মেলায় পুজা অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সময়ের পালা বদলে এ বউমেলা এখন তার অতীত জৌলুস হারিয়ে অনেকটাই বর্ণহীন হয়ে গেছে। মেলার জন্য পর্যাপ্ত স্থান না থাকার কারনে মেলায় আগত দর্শনার্থীদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাছাড়া আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম গঞ্জে পালিত হওয়া ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। তারপরও কোনো রকমে টিকে থাকা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এসব মেলা আমাদেরকে নিয়ে যায় শেকড়ের গভীরে।


আরো সংবাদ



premium cement
চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা : যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ২০ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ নিহত আইনজীবীকে নিয়ে অপপ্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যম : প্রেস উইং হিজবুল্লাহ-ইসরাইল অস্ত্র-বিরতি চুক্তি জয় দিয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শুরু করতে চায় টাইগ্রেসরা সহজ জয়ে সিরিজে সমতা পাকিস্তানের ইসলামাবাদের বিক্ষোভের স্থগিত ঘোষণা পিটিআইয়ের নিটওয়্যারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে চিশিং ‘বাংলাদেশ নাইট’ অনুষ্ঠিত হিজবুল্লাহর সাথে অস্ত্র-বিরতি চুক্তি অনুমোদন ইসরাইলের অ্যাডভোকেট আলিফের খুনিদের কঠোর শাস্তি হবে : নাহিদ ইসলাম আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা

সকল