০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬
`

হাওরে একদিকে নদী তীর রক্ষায় শতকোটি খরচ, অনদিকে বেপরোয়া বালু লুট

ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তেলন করা হচ্ছে। - ছবি : নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জের নিকলীসহ হাওর অঞ্চলের নদী তীর রক্ষায় একদিকে সরকারের শতশত কোটি টাকার কাজ চলে অপরদিকে বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে নদীর বুক থেকে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত বালু খেকোরা। বালু খেকোদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে তীরবর্তী ফসলি জমি ও বিক্ষিপ্ত স্থানের বসতি। জনবহুল মূল রাস্তায় পাশে চোখ মেললেই দেখা যায় অবৈধ উপায়ে জমা রাখা বালু-মাঠির স্তূপ। সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে উন্নয়নমূলক কাজের দোহাইয়ে প্রভাবশালী ও স্থানীয় অসাধু নেতাকর্মীরা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় নেতাকর্মীদের কোটিপতি বনে যাওয়ার সহজ উপায় নদীর বুকের বালিমাটি উত্তোলন। কথায় বলে নদী নয় যেনো অপরাধীদের টাকার গাছ। তদারকির ঘাটতির কারণে নদী সরকারের হলেও বালু যেনো যুগে যুগে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালীদের।

নদীমাতৃক এদেশের হাওর অঞ্চলের প্রাণ বলা হয় নদীকে। উত্তর পূর্ব সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহমান একটি নদীর নাম ঘোড়াউত্রা। আর সিলেটের উত্তর পূর্ব সিমান্তের বৃহৎ একটি নদী সুরমা। যা উজানের ভারত থেকে নেমে এসেছে বাংলাদেশে। জকিগঞ্জের বরাক মোহনায় এর উৎপত্তি। সেখান থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে দুটি ভাগে একটি সুরমা অপরটি কুশিয়ারা। সুরমা নদীটি সুনামগঞ্জ থেকে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে নেত্রকোনা জেলার কালিয়াজুড়ি হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায় প্রবেশের পর প্রবাহিত হয়েছে ধনু নদী নামে। এটি মিঠামইন ও নিকলীতে এসে ঘোড়াউত্রা নাম ধারণ করে বাজিতপুরের উপর দিয়ে কুলিয়ারচরের কাছাকাছি গিয়ে পতিত হয়েছে ভৈরর সীমান্তবর্তী মেঘনায়। এই নদীর দু'পাশে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন বসতি ও বিপুল পরিমাণে ফসলি জমি।

দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশ কিছু অসাধু নদীর বালুমাটিকে কেন্দ্র করে দখল বাণিজ্যের সুযোগে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন বলে দীর্ঘদিন থেকেই সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে। সুযোগ নিতে মরিয়া এবার স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীর অনেকে। অসংখ্য স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে এই নদীর বালু বিক্রিকে কেন্দ্র করে কোটিপতি বনে যাওয়াদের মধ্যে নিকলী সদরসহ ছাতিরচর, সিংপুর, গুরই, কারপাশাসহ বাজিতপুর উপজেলার হিলোচিয়া, দীঘিরপাড়, হুমাইপুর, মাইজচর ও দিলালপুর ইউনিয়নসহ অষ্টগ্রামের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতিদের প্রায় সবাই কোটিপতি বনে গেছেন বালি উত্তোলনকে কেন্দ্র করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে যুগে যুগে স্থানীয় অসংখ্য অবৈধ বালু খেকোদের দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে বিক্ষিপ্ত স্থানের প্রাচীন অসংখ্য বসতি। নিকলীর ছাতিরচরের মরহুম নসু মিয়া, মরহুম মাওলানা নুর উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, দুদু মিয়া, জঙ্গু মিয়া, মধু মিয়া ও কবি মহিবুর রহিমের মতো কয়েকশ’ পরিবার নদী ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। নদীর এক দিক দিয়ে যখন বালি উত্তোলনকারীরা ড্রেজারে বালি তোলে তখন আশপাশের উচু স্থান ভেঙে নদী তার গর্তের ঘাটতি পূরণ করে। এভাবেই সৃষ্টি হয় ভাঙনের।

সরেজমিনে দেখা মিলে ঘোড়াউত্রা নদী তীরবর্তী এলাকাবাসীর বসতভিটা ও ফসলি জমি বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়দের ভাষ্য এসবের জন্যে দায়ী স্থানীয় বালু খেকোরা। যদিও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার হাওর রক্ষা ও বাঁধ প্রকল্পের নামে শতশত কোটি ব্যয় দেখিয়েছে ভাঙন রোধের লক্ষ্যে। এসব কাজ চলমান রয়েছে জেলার অসংখ্য ছোট-বড় প্রজেক্টের মাধ্যমে।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের ১০টি উপজেলায় নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজের, ওয়েভ প্রটেকশন এবং খাল পুনঃখনন প্রকল্পের মধ্যে ১৫ জুলাই, ২০২৩ সালে যে কয়টি কাজ স্থানীয় সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের মাধ্যমে উদ্বোধন হয় এসবের মধ্যে ছাতিরচর গ্রামে ১৪০০ মিটার নদী তীরবর্তী প্রকল্পের চুক্তি মূল্য ৫২১৫.৭০ লাখ টাকা, সিংপুর গ্রামের ১০০০ মিটারের ৩৫৫৯.৮৩ লাখ টাকা। সিংপুর বাজারের ১২০০ মিটারের জন্যে ৪২২৮.৯৭ লাখ।

জানা গেছে, এর মধ্যে ছাতিরচরে নদী তীরবর্তী রক্ষায় ৬০ কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আতিকুর রহমান (এসডিই) এর দেয়া তথ্যমতে শুধু নিকলীতেই সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ডেরই ৩.৬০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজের চুক্তিমূল্য ১৩০.০৪ কোটি টাকা। যা ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজের মানের বিষয়ের পাশাপাশি সমালোচনা উঠেছে যথা সময়ে সমাপ্তি নিয়েও। এসব মেগা প্রকল্পে কোনো কাজ এখনো দৃশ্যমান হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও থেমে নেই বালু খেকোদের দৌরাত্ম্য। ছাত্র-জনতার রক্তঝরা আন্দোলনে টানা চতুর্থ মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও গণতন্ত্রের অজেয় শক্তির কাছে দলীয় শক্তির বিপর্যয়ের এই ইতিহাস থেকেও শিক্ষা নিতে পারছে না টানা ১৫ বছরের সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানালেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের হাওরের সাম্রাজ্য দখলে নিচ্ছে বিএনপি।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে সিংপুর ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি হারুন অর রশিদসহ জড়িত রয়েছেন শান্তি রহমান ও আবুল্লা সর্দার। তবে মোবাইল ফোনে হারুন অর রশিদ ও আবুল্লা সর্দার বালু উত্তোলন বিষয়ে কিছু জানা নেই উল্লেখ করে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এদিকে থানা বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পরিচয়ে শান্তি রহমান বালু উত্তোলন হচ্ছে স্বীকার করলেও তিনি প্রতিবাদ করেছেন বলে জানান। বালু নিজে উত্তোলনে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। স্থানীয় হদয়, খোকন ফকরুলসহ অন্তত চারজন বালু উত্তোলনে জড়িত বলে তিনি বলেন। তবে বিএনপির কর্মী সমর্থক দাবিদার হৃদয় মোবাইল ফোনে বালু দিয়েছেন জিও ব্যাগের জন্যে এ কথা স্বীকার করলেও ধনু নদীর পূর্ব পাড়ের হেমারচর অংশ থেকে তিনি বালু উত্তোলন করেননি বলে দাবি করেন।

নিকলী উপজেলা বিএনপির আহবায়ক বদরুল মোমেন মিঠু বলেন, এর সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আমিও আইনি হস্তক্ষেপ কামনা করি। বালু খেকোদের জন্যেই নদী সংলগ্ন অংশের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে থাকে। তাই দ্রুত আইনি হস্তক্ষেপ কামনা করি। হোক সে যে কোনো দলের হোক না কেন।

নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তারের সাথে ধনু নদী থেকে বালি উত্তোলনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হলে তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান। পাশাপাশি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা বালু উত্তোলন করে চলেছেন এ প্রশ্নের জবাবে- কথাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে উড়িয়ে দেন।

কিশোরগঞ্জের নিকলীর সিংপুরের ধনু নদীর পূর্ব পাড়ের হেমারচর ঘেঁষে অবৈধ উপায়ে ২৭ ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বালু উত্তোলনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খাঁনকে জানানো হলে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।


আরো সংবাদ



premium cement
বিএফআইইউ প্রধান হতে এস আলম ও আ’লীগের সুবিধাভোগীদের দৌড়ঝাঁপ পদ ছাড়াই রূপালী ব্যাংকে ঢালাও পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন নিম্ন আদালতের ৫০ বিচারক দুপুরে সূর্য উঁকি দিলেও রাত কেটেছে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সীমান্ত নদীগুলোতে ভাসমান চৌকি বসিয়েছে ভারত বাংলাদেশী রোগী কমায় বিপাকে ভারতের চিকিৎসাশিল্প যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি চায় হামাস সত্য তথ্য তুলে ধরতে নয়া দিগন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীতে ঠাসা ছিল ৬৮ কারাগার ইসলামী সভ্য সমাজ গঠনে প্রয়োজন জ্ঞান ও ঐক্য

সকল