২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
পরিবেশ বিপর্যের প্রভাব

হাওর অঞ্চলে কমেছে মৌমাছি, নেই মৌ-মৌ শব্দ

- সংগৃহীত

হাওর অঞ্চল থেকে কমে যাচ্ছে মৌমাছি। স্থানীয় কৃষকের বেশিভাগেরই ধারণা নেই উপকারী ক্ষুদ্র মৌমাছি সম্পর্কে। অনেকের মাঝেই এ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে। তবে গবেষক ও কৃষি অফিসের ভাষ্যমতে, মৌমাছি বিলুপ্তির পরিত্রাণের লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। মৌমাছি বিলুপ্ত হলে নষ্ট হবে পরিবেশের ভারসাম্য। ফলে পরিবেশ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।

পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার পেছনে অবদান রয়েছে পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষরাজি ও বিভিন্ন প্রকারের জড়, জীব আর অনুজীবের। বৃক্ষ যেমন প্রাণীকূল রক্ষার্থে সহায়তা করে ঠিক তেমনি প্রতিটি প্রাণীও মানুষের উপকার করে থাকে কোনো না কোনো উপায়ে। এদের মধ্যে অতিক্ষুদ্র এক প্রাণী হচ্ছে মৌমাছি।

গবেষণা ও বিভিন্ন তথ্যে উঠে এসেছে, গাছে ফুল ও ফল হওয়ার অন্যতম কারণ মৌমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ। মৌমাছির মতো কীটপতঙ্গ না থাকলে গাছে ফুল ফুটত না, ফলও হতো না। অধিকাংশ বনজ উদ্ভিদে পরাগায়ন ঘটায় মৌমাছিরাই। ফলজ ও কৃষিজ ফসলের পরাগায়নের ক্ষেত্রেও মৌমাছিরা সহায়তা করে। মৌমাছিরা একদিকে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে যেমন সহায়তা করে অপরদিকে মধুও আহরণ করে।

মৌমাছির সাধারণত দু’টি পাকস্থলি থাকে, আর দ্বিতীয় পাকস্থলিতে মৌমাছি মধু জমা রাখে। মধু পাকস্থলীতে থাকা অবস্থায় নষ্ট হয় না। মৌমাছি যখন তার চাকে ফিরে তখন জমিয়ে রাখা সেই মধু মুখ দিয়ে উগড়ে দেয়। ফুল ও ফলের নির্যাস থেকে সংগৃহীত উচ্চ ঔষধি গুণসম্পন্ন এই ভেষজ তরল খাদ্যটির মধু হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে।

পরিবেশবান্ধব এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি মানুষের নানাবিধ উপকার করে থাকে। এই উপকারী মৌমাছির প্রতি সরকারি ও বেসরকারিভাবে যদি গুরুত্ব না দেয়া হয় তাহলে এক সময়ে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছি বিলুপ্ত হলে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিবে পরিবেশেও। তাই উপকারী এই ক্ষুদ্র প্রাণী মৌমাছিকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। যদিও মৌমাছিদের আয়ুষ্কাল আবহাওয়ার তারতম্য এবং অনুকূল পরিবেশের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। এছাড়াও মৌমাছির আয়ুষ্কাল বা জীবনকাল তাদের প্রকারভেদ এবং কাজের ওপরও নির্ভর করে।

সাধারণত তিন শ্রেণীর মৌমাছি রয়েছে- রানী মৌমাছি, কর্মী মৌমাছি এবং পুরুষ মৌমাছি। সুস্থ একটি রানী মৌমাছি উপযুক্ত পরিবেশে সাধারণত দুই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। রানী মৌমাছি সাধারণত ডিম পাড়ার কাজ করে থাকে। কর্মী মৌমাছি গ্রীষ্মকালে সাধারণত ছয় থেকে সাত সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচে। শীতকালে এদের জীবনকাল বেড়ে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। ওরা চাক তৈরি, মধু সংগ্রহ এবং চাক রক্ষায় কাজ করে থাকে। পুরুষ মৌমাছির জীবনকাল সাধারণত কয়েক সপ্তাহ থেকে দু’মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। তারা শুধুমাত্র রানীর সাথে মিলন ঘটিয়ে থাকে। গবেষকদের মতে, গ্রীষ্ম ও বসন্তকাল ছাড়া বাকি মৌসুমে পুরুষ মৌমাছিরা সাধারণত অলস সময় কাটায়।

সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের নিকলী, বাজিতপুর, অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইনসহ একাধিক উপজেলা ও সংলগ্ন জেলার বিভিন্ন হাওর অঞ্চলের বিক্ষিপ্ত স্থানে সরিষার আবাদ দেখা যায়। সরিষার জমিকে দূর থেকে মনে হয় যেন হলুদ বর্ণের ফুলের ন্যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সাজানো লীলাভূমি। পরিতাপের বিষয় এই মৌসুমে হাওর অঞ্চলের সরিষার ফুলে তেমন একটা মৌমাছির দেখা মিলছে না। তবে স্থানীয় কৃষক ও মৌয়ালদের আফসোস, সরিষা ক্ষেতে এখন আর আগের মতো দেখা মিলে না মৌমাছিদের। শোনা যায় না মৌমাছির গুনগুন শব্দের গুঞ্জন। চোখে ধরা পড়ে না ঝাঁক বেঁধে চক্রাকারে আকাশ পানে ছুটে চলা মৌমাছির মনোরম দৃশ্যও। যদিও দলবদ্ধ মৌমাছি অনেক সময় আতঙ্কের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। এই ভয়ে অনেকেই মৌমাছির চাক ভেঙে দেয়।

কটিয়াদী উপজেলার মানিকখালী চাঁন্দপুর গ্রামের ভ্রাম্যমান মাওয়াল ইদু মিয়া আফসোস করে বলেন, আগের মতো এখন আর মৌমাছির চাক পাওয়া যাচ্ছে না। যদি কোথাও পাওয়া যায়ও, তবুও মিলে না তেমন একটা মধু পাওয়া যায় না। নিকলী জারইতলা রসুলপুর বাজারের প্রবীণ মিষ্টির কারিগর যতীন্দ্র চন্দ্র ঘোষের ভাষ্যমতে এখন আর মিষ্টির দোকানে আগের মতো মৌমাছিদের দেখতে পাওয়া যায় না। মৌমাছির পরিমাণ এলাকায় তুলনামূলক অনেকটা কমে গেছে বলেও তিনি জানান।

বাজিতপুর উপজেলার সরারচর বাজারের হোমিও ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডা. আশরাফুল ইসলাম আফসোস করে বলেন, আজকাল নানান ওষুধ তৈরির জন্যে সরিষার মৌসুমেও এলাকায় মধু পাওয়া যায় না। বাজারের বিভিন্ন ধরনের কোম্পানির মধু ব্যবহার করা হয় ওষুধ তৈরির কাজে। এভাবে যদি মৌমাছি দিন দিন কমতে তাহলে তা নিশ্চিত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে পরিবেশ ও মানুষের জন্যে। হাওর অঞ্চলের অসংখ্য কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেশিভাগেরই ধারণা নেই এই উপকারী মৌমাছির সুফল সম্পর্কে। বরং অনেকের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে।

উপকারী এ মৌমাছি সম্পর্কে পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা, বনজ ও প্রাণিজ সম্পদ কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকতা এমনকি একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে কথা হলে তারা তাদের বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক যুক্তি উপস্থাপনের পাশাপাশি মধু আহরণকারী মৌমাছি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কেও আলোচনা করেন। এমনকি উপকারী মৌমাছি ও তার পুষ্টিগুণ মধু নিয়েও পর্যালোচনা করেন।

প্রাথমিকভাবে গবেষণায় উঠে এসেছে, অস্বাভাবিক আবহাওয়াজনিত তারতম্য ও ঋতু পরিবর্তনের বিষয়টি এর প্রধান কারণ। এছাড়াও বাতাসে অতিরিক্ত সীসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এবং অভয়ারণ্যে বাধাগ্রস্ত হওয়াটাও মৌমাছি বিলুপ্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তথ্য মতে দেখা গেছে, মধু সংগ্রহের নেশায় মৌচাকে মৌয়ালদের আক্রমণের প্রভাব। কৃষি জমিতে কিংবা ফুল-ফলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। অনেক এলাকায় দেখা গেছে মৌয়ালরা অতিরিক্ত পরিমাণে মধু সংগ্রহের নেশায় অবৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌমাছি লালন পালন করছে। এতে মৌমাছির বংশবৃদ্ধি অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি কুপ্রভাব পড়ে গ্রাম অঞ্চলে অদক্ষ লোকেরা যখন আগুন আর ধোঁয়ার আঁচ দিয়ে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। এ সময়ে অগণিত মৌমাছি মারা যায়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাওর এলাকায় বড় বড় গাছপালা কেটে ফেলছে ইটভাটার জন্য। বৃক্ষনিধন আর ইটা ভাটার কালো ধোঁয়া দূষিত করছে পরিবেশ। ফুল-ফলের মুকুলে বাধা ও খাদ্য সংগ্রহে জটিলতা এ সকল পারিপার্শ্বিক অবস্থা এর জন্যে দায়ী। যে কারণে ২০১৮ সালে আইইউসিএনের ঝুঁকিগ্রস্ত প্রাণীদের রেড লিস্টেও দেখা যাচ্ছে প্রজাপতি আর ভ্রমরের মতো উপকারী পতঙ্গ।

আমাদের দেশে সাধারণত পাহাড়িয়া, ক্ষুদে ও খুড়েল নামের তিন প্রজাতির মৌমাছির দেখা মেলে। তুলনামূলক বড় গাছে ও দালানের কার্নিশে পাহাড়ি মৌমাছিরা চাক বাঁধে। খুদে মৌমাছিরা সাধারণত মানুষের নজরের অনেকটা আড়ালে বনজঙ্গলে আর ঝোপ-ঝাড়ের ভেতরে ছোট গাছে চাক বাঁধে। এছাড়াও খুড়েল মৌমাছি বিভিন্ন ধরনের বড় গাছের কুঠুরিতে বাসা বাঁধে।

সচেতন মহলের ভাষ্যমতে, মধুর পরিমাণ উত্তরবঙ্গের সুন্দরবন এলাকাতে তুলনামূলক বেশি দেখা গেলেও মধু সংগ্রহকারী অসাধু মৌয়ালরা মৌচাক পরিপক্ক হওয়ার আগেই তা ভেঙ্গে ফেলে। এতে প্রজনন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয় এবং মধুর পরিমাণও কমে যায়। এভাবে অপরিপক্ক মৌছাক একের পর এক ভাঙতে থাকলে আর মৌচাকে তাড়া করে বেড়ালে অদূর ভবিষ্যতে এই সব এলাকা থেকেও মৌমাছি বিলীন হয়ে যাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

অনেকে আবার যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন শুধু মৌমাছিই নয় সাত রঙের প্রজাপতি, উপকারী ব্যাঙ, মাছ এমনকি গুইসাপসহ যে সকল উপকারী প্রাণী রয়েছে তাদের দিকে সরকারি-বেসরকারিভাবে গুরুত্ব না দিলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।

জেলা কৃষি অফিসের আবুল কালাম আজাদের সাথে কথা হলে তিনি মৌমাছির পরাগায়ন এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে মৌমাছির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা বলেন। পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে মৌসুমী কিছু ফসলের ক্ষেত্রে মৌ-বক্স তৈরি করে ফসলে পরাগায়ন রক্ষার উদ্যেগ নিতে যাচ্ছেন বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। মৌ-বক্স মৌমাছির বংশবিস্তারে অনেকটা সহায়ক হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আ. হামিদের সাথে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সদর দফতরের সহকারী পরিচালক কাজী নাজমুল মাহমুদের সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মৌমাছির ভূমিকা এবং জীববৈচিত্র্যর ভারসাম্য রক্ষায় কতটা উপকারী এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি অধীনস্থদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। এই বিষয়ে তিনি ততটা অভিজ্ঞ নন বলেও দাবি করেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. শেখ শাহীনুল ইসলামের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা হলে মধু আহরণকারী মৌমাছির পরিমাণ হাওর অঞ্চল থেকে কমে যাওয়ার জন্যে অনুকূল পরিবেশে বাধা, আবহাওয়াজনিত তারতম্য, অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ এবং কৃত্রিম উপায়ে অসাধুরা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহের জন্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে লালনপালনকেও অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement