২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ছেলে আর ফিরবে না, তবু ভাত নিয়ে অপেক্ষায় মা...

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হন মো: মোস্তফা জামান সমুদ্র - ছবি - বাসস

আদরের ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আর ফিরে আসবে না। তবুও ভাত নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। এই অপেক্ষা আর শেষ হয় না মা মাসুদা জামানের (৫৯)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই শহীদ হন তার ছেলে মো: মোস্তফা জামান সমুদ্র (১৭)।

চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মাসুদা জামান বলেন, আমার বাবা আর ভাত খেতে আসে না। আমি অপেক্ষায় থাকি। আমার অপেক্ষা শেষ হয় না।

শহীদ সমুদ্রের মা বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্যে রক্ত দিলো। অথচ কেউ খোঁজ নেয় না।’

ছেলের আত্নত্যাগের এই স্বীকৃতি যেন দেয়া হয়। সরকার যেন সকল শহীদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়। এ দাবি শহীদ সমুদ্রের বাবা মো: মনিরুজ্জামান তাজুলের (৬৮)।

মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া গ্রামের নিবাসী মো: মনিরুজ্জামান তাজুল ঢাকার রামপুরায় মহানগর প্রজেক্টে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তার ছেলে সমুদ্র ঢাকার আল-ফোরকান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। সিদ্বেশ্বরী কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

মনিরুজ্জামান তাজুল বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সমুদ্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। গত ১৯ জুলাই অন্যান্য দিনের মতো সকালে বাসা থেকে সহপাঠীদের সাথে রামপুরায় ডিআইটি রোডে নেমে আসে। বেলা ৩টায় আমি জুমার নামাজ শেষে বাসায় এসে ভাত খেতে বসি। আর সমুদ্রের মা নামাজে দাঁড়ায়। এমন সময় ওর এক বন্ধু ফোন করে বলে, সমুদ্র গুলিবিদ্ধ হয়ে ডেলটা হাসপাতাল আছে।

কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্রের বাবা আরো বলেন, খাবার ফেলে দৌড়ে ডেলটা হাসপাতাল গিয়ে দেখি পাঁজরে গুলিবিদ্ধ আমার ছেলে খালি গায়ে মেঝেতে পড়ে আছে। শরীরে হাত দিয়ে দেখি শরীর গরম। সাথে সাথে কোনো রকমে সেখান থেকে পাশের বেটার লাইফ হাসপাতাল নিয়ে যাই। সেখানকার ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেদিন রাতেই নিজ গ্রামে এনে জানাজা শেষে দাফন করি তাকে।

তিনি বলেন, সমুদ্র এর আগের দিন আন্দোলনে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসায় আসে। ঘটনার দিন নিষেধ করেছিলাম বাইরে যেতে। তারপরও সকালে বন্ধুদের সাথে রাজপথে নেমে আসে। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তির জন্য ফরম এনেছিল। পরের রোববার ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। সমুদ্রের ইচ্ছা ছিল পড়াশুনা শেষ করে দেশেই ব্যবসা করবে।

মনিরুজ্জামান বলেন, দুই ছেলে আর এক কন্যার মধ্যে সমুদ্র ছিল সবার ছোট। বড় ছেলে মোর্শেদুজ্জামান পিএইচডি করে জাপানে আছে। আর মেয়ে মিরানা জামান স্বামীর সাথে ফিনল্যান্ডে বসবাস করে। ইচ্ছা ছিল ছোট ছেলেকে নিয়ে দেশেই থাকব। ব্যবসা বাণিজ্য করব। সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। তাই ঢাকায় সব ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি।

সেদিনে ঘটনা মনে করে শহীদ সমুদ্রের মা বলেন, সমুদ্র সকালে বলে যায় জুম্মার নামাজ পরে বাসায় এসে দুপুরের ভাত খাবে। আমি ভাত বেড়ে সন্তানের অপেক্ষায় থাকি। দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে ফোন করে সমুদ্রকে বাসায় খেতে আসতে বলি। সে দুই মিনিট পরে আসার কথা বলে। দুপুর গড়িয়ে যায়। সমুদ্র বাসায় আসে না। টেবিলে ভাত বেড়ে আমি নামাজ পড়তে যাই। নামাজ পড়া অবস্থায় ফোন আসে সমুদ্র গুলি খেয়েছে।

সমুদ্রের বাবা মনিরুজ্জামান তাজুল বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। আর কেউ খোঁজ নেয়নি। কোনো আর্থিক সাহায্য চাই না।

আদরের সন্তান অবিচার অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। তাই সরকারের কাছে দাবি আমার ছেলেসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়।

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement