গাজীপুরে আবারো মহাসড়ক অবরোধ শ্রমিকদের, আরো ১৫ কারখানা ছুটি
- মোহাম্মদ আলী ঝিলন, গাজীপুর
- ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:১০, আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৪১
গাজীপুরে টানা ৫৩ ঘণ্টা পর বেতন পরিশোধের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নিয়েছে টিএনজেড গ্রুপের পোশাক শ্রমিকরা। কিন্তু এর ঘণ্টাখানেক পরেই একই দাবিতে আবার সড়কে নেমেছে তাদের একটি অংশ। এ ঘটনায় ভাঙচুর এড়াতে আশপাশের আরো ১৫টি কারখানার ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
শ্রমিকরা এর আগে শনিবার সকাল ৯টা থেকে বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ ও বন্ধ কারখানা চালুর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল। এরপর সোমবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল তারা। এর পর পরই জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধির নেতৃত্বে শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধি দল শিল্প মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করার জন্য ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।
পুলিশ ও আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানায়, মহানগরীর মোগরখাল এলাকার টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের পাঁচটি কারখানায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক-কর্মচারি রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকদের গত দুই মাসের (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) বেতন বাবদ প্রায় ১৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। কর্তৃপক্ষ একাধিকবার আশ্বাস দিয়েও তা পরিশোধ করেনি। গত ৩ নভেম্বর শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু সেদিন তারা বেতন পরিশোধ না করে কারখানা তালাবদ্ধ করে রাখে। এরপর থেকে মালিক পক্ষের কোনো লোকজন কারখানায় আসেননি। এমনকি কারখানাটির উৎপাদন কাজও বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে কারখানায় এসে ফিরে যান। এতে শ্রমিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে শনিবার সকালে শ্রমিকরা কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে সকাল ৯টার দিকে তারা কারখানার পার্শ্ববর্তী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কলম্বিয়া কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে ওই মহাসড়কের উভয় পাশে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
খবর পেয়ে শিল্প ও থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়কের উপর থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের দাবিতেই অনড় থাকে। তারা রাতে সড়কেই অবস্থান করতে থাকে। তারা তিন দিন ধরে সোমবার দুপুর পর্যন্ত টানা প্রায় ৫৩ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। এ সময় দিনে ও রাতে পালাক্রমে তারা অংশ নিয়ে কর্মসূচি অব্যাহত রাখে।
লাগাতার অবরোধের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে গাজীপুরের জনজীবন। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয় দিকে প্রায় ২০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিকল্প পথে চলাচল করতে গিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-বাইপাস মহাসড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কগুলোতেও হাজার হাজার যানবাহন আটকা পড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে স্মরণকালের তীব্র যানজটের কারণে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়েন রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা। তরিতরকারি ও কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যবাহি যানবাহন আটকা পড়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এমনকি বিদেশগামী যাত্রীরা নির্ধারিত সময়ে বিমান বন্দরে পৌঁছতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে যান। এতে ওই সড়কে চলাচলকারী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজনের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এহেন পরিস্থিতিতে সোমবার সকাল হতে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদ মিয়াসহ সেনাবাহিনী, র্যাব, শিল্প ও থানা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়কের উপর থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ইউএনওর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ এম শফিকুজ্জামান শ্রমিকদের সাথে কথা বলেন। তাদের এ কথোপকথন মাইকে প্রচার করা হয়। এ সময় শিল্প সচিব শ্রমিকদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আগামী রোববারের মধ্যে সরকারের উদ্যোগে ছয় কোটি টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করা হবে। অবশিষ্ট পাওনা টাকা পরিশোধের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের জন্য প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বন্ধক রাখা হবে। এ সময় তিনি জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করেন। তার এ আশ্বাসের প্রেক্ষিতে দুপুর সোয়া ২টার দিকে শ্রমিকরা মহাসড়কের অবরোধ প্রত্যাহার করে। পরে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি ইউএনও এরশাদ মিয়া আন্দোলনরত শ্রমিকদের ২৫ থেকে ২৬ জনের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে ঘটনাস্থল থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সন্ধ্যায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের সাথে আলোচনা চলছিল।
এদিকে, অবরোধ প্রত্যাহারের প্রায় এক ঘণ্টা পর বিকেল পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের একটি অংশ ফের ওই এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে। দ্বিতীয় দফায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে। এতে আবারো জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধের দাবির সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয় অবরোধকারীরা।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় শিল্প পুলিশের ইন্সপেক্টর ফারুকুল আলম জানান, শ্রমিকরা এখন পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে। তাদের একটি প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে গেছেন। আলোচনার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তারা অবরোধ কর্মসূচির ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে সুষ্ঠু সমাধান না হলে অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে বলে শ্রমিকরা জানিয়েছে।
এ সময় তিনি আরো জানান, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সোমবার ওই প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের আরো ১৫টি কারখানাসহ গত তিন দিনে প্রায় ৪৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইবরাহিম খান বলেন, শনিবার থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড গ্রুপের আন্দোলনরত শ্রমিকরা। তৃতীয় দিন সোমবার দুপুরে অবরোধ প্রত্যাহারের কিছু সময় পর তারা আবার মহাসড়ক অবরোধ করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।