২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ফরিদপুরে যেভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ

ফরিদপুরে যেভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ - ছবি : সংগৃহীত

ফরিদপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জড়িত। কিন্তু ন্যাক্কারজনক হলেও সত্য যে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সাথে রাজপথে ভুমিকা রাখা এই সংগঠনটি নব্বইয়ের দশক থেকে যেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য হয়ে উঠে ফরিদপুরেও।

শুধু প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপরে চড়াও হওয়াই নয়, তারা জড়িয়ে পড়ে খুন-জখম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ধর্ষণ, সরকারি জমি দখল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদককারবার, তদবির বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ অনৈতিক ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।

২০০৯ সালের পর এসব পরিচালিত হয়ে এসেছে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক শক্তিকে ব্যবহার করেই। এই সময়ে ফরিদপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতিকে কলুষিত ও ধ্বংস করার জন্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের চেয়েও বেশি দায়ি করা হয় সাবেক এমপি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীকে।

ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মী সমর্থকদের অভিযোগ, করোনা ও রোজায় ছাত্রলীগের সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এই ছাত্র সংগঠনের সকল অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। শুধু কলেজ ক্যাম্পাসই নয়, আওয়ামী লীগের হেলমেট বাহিনী হয়ে তারা টেন্ডারবাজি, জমি দখল, মাদককারবার ও তকবির বাণিজ্যসহ নানা কারবারে জড়িয়ে পড়ে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের মিছিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি ভারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গুলি চালানোর ভিডিও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে ফরিদপুরের ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র রাজেন্দ্র কলেজে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকা ছাত্রলীগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা চালিয়ে কলেজে আধিপত্য ও রুকসুর প্রতিনিধিত্ব লাভের পরে একসময় তারা নিজদলের প্রতিপক্ষের ওপরেও হামলে পড়ে। সেসময় রাজেন্দ্র কলেজ ছাড়াও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তারা সন্ত্রাসের ঘাঁটি গেড়েছিল। বহিরাগত ছাত্রদের হাতে স্থানীয়রাও জিম্মি হয়ে পড়ে। ফরিদপুরের লাট ভাই খ্যাত এক আওয়ামী লীগ নেতার প্রশ্রয়ে চলত এসব ঘটনা। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনের এই চিত্রও বদলে যায়। পতন হয় লাট ভাই ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীদের।

২০০৩ সালে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন মনিরুজ্জামান মনির ও সাধারণ সম্পাদক হন সত্যজিৎ মুখার্জি। ছাত্রলীগের এই অংশ ছিল তৎকালীন এমপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরোধী জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান লাবলুপন্থী। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে তারা আওয়ামী লীগের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।

মাত্র এক বছর না যেতেই ২০১০ সালের ১০ মার্চ ফরিদপুর প্রেসক্লাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন মোশাররফপন্থীদের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডে টেন্ডারবাজির অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির। এর পরপরই মিছিলে হামলা চালিয়ে মনিরকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে প্রতিপক্ষ মোশাররফপন্থীরা। এ সময় মোশাররফপন্থী এক সাবেক ছাত্রলীগের নেতার নেতৃত্বে ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপক আব্দুল হালিমকে কিল-ঘুষি মেরে আহত করা হয়।

২০১৫ সালে একযুগ পরে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন নিশান মাহমুদ শামীম ও সাধারণ সম্পাদক হন সাইফুল ইসলাম জীবন। ২০২০ সালে কথিত শুদ্ধি অভিযানে খন্দকার মোশাররফের পতনের আগ পর্যন্ত তারাই ছিল ছাত্রলীগের পদে। মূলত এই সময় থেকেই যুবলীগের সাথে মিশে দানবীয় হয়ে উঠে ছাত্রলীগ। ফরিদপুরে ছাত্রলীগ এ সময় আবির্ভূত হয় ভয়ংকর হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনীর ভুমিকায়। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে পর পুলিশের সহযোগিতায় হামলা চালিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে একক আধিপত্য কায়েম করে।

২০২০ সালের আগস্টে জেলা ছাত্রলীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় শামীম ও সাইফুলকে। এরপর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আব্দুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক পদ লাভ করে তানজিলুর রশীদ চৌধুরী রিয়ান ও সাধারণ সম্পাদক হন ফাহিম আহমেদ। এখনো তারা এই পদে বহাল।

জানা যায়, ২০০৪ সালের পর ১৩ বছর বন্ধ ছিল রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদ রুকসু নির্বাচন। ২০১৭ আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ২০১৯ সালের পর আবার বন্ধ হয়ে যায় এ নির্বাচন। তবে তখন থেকে রুকসুর ভবনটি জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা রুকসু ভবনে জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয়ের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়। খন্দকার মোশাররফ জামানায় ক্ষমতার ছায়াতলে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে রুকসু ক্যাম্পাস হয়ে উঠে মাদক আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। রাজেন্দ্র কলেজের শহর শাখার হোস্টেল থেকে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার তত্ত্বাবধানে শহরে মাদকের সরবরাহ করা হতো। এখান থেকে বেরিয়ে জড়িত হতো ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে। এ সময়কালে রুকসু ভবন দখল করে সন্ত্রাসী ও মাদকসেবীদের আস্তানায় পরিণত করা হয়।

২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে শহরের ঝিলটুলী এলাকায় ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হন ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ নার্স অরুনিমা ভৌমিক। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হাবিবুর রহমান টিটু ও শরিফুল ইসলাম ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর সদস্য ছিল। ২০১৯ সালের ১৮ মে গভীর রাতে ভাঙ্গা রাস্তার মোড়ে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে ডা. আদনান নামে ফরিদপুর মেডিক্যালের এক ডাক্তারকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরের জেনারেল হাসপাতালে ঢুকে সেখানে চিকিৎসাধীন এক নারী রোগীর স্বজন রাসেল নামে যুবককে কুপিয়ে জখম করে জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দেবাশীষ রায়।

ওই বছরের ৬ আগস্ট শহরের বায়তুল আমান-চাঁদমারি এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বিবাদে নিহত হন সবুজ নামে এক যুবক। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রুকসু ক্যাম্পাসে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসে আহত হন ছাত্রলীগের অপর পক্ষের কর্মী সৌরভ মালোসহ আরো কয়েকজন। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট অস্ত্র নিয়ে মহাসড়কে মহড়ার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের একাংশ অভিযোগ করে জেলা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ মাদককারবারিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর ফরিদপুরে যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিএনপির শামা ওবায়েদের একটি বিক্ষোভ সমাবেশে হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ ও চেয়ার ভাঙচুর করা হয়। সর্বশেষ ফরিদপুরে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ বিবাদ প্রকাশ্য রূপ নেয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহিমের ১৫ থেকে ২০ জন সমর্থক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক আফিফের সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়ে দু’জনকে কুপিয়ে জখম করে। এরপর জেলা ডিবি পুলিশের একটি দলের সাথে বোয়ালমারীতে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে গত জুন মাসে।

ছাত্রলীগের রাজনীতির অবনতির এই ধারাবাহিকতায় এই সময়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের মতো একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্রলীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির মাধ্যমে কলুষিত করা হয় ফমেকের ক্যাম্পাস। সম্প্রতি ফরিদপুর মেডিক্যালের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ছাত্রলীগের বহুল আলোচিত তৎকালীন সভাপতি মাশতুরা মোশাররফ ঐষিকা ও সম্পাদক ইমরুল হাসান জীমের সনদ স্থগিতসহ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া সভাপতি-সম্পাদককে ক্যাম্পাসে আজীবন অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। একইসাথে আরো ১৬ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে ইন্টার্নশিপ বাতিল, সনদ স্থগিত, ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কারসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। তবে রাজেন্দ্র কলেজের রুকসু ভবন দখল করে হেলমেট বাহিনীর ভূমিকায় থাকা ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি আজো। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা খবরও জানা যায়নি এখন পর্যন্ত। সপ্তাহ খানেক আগে এক সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানো হয় ঝিলটুলীতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বাড়িতে। তবে কোনো গ্রেফতার বা অস্ত্র উদ্ধারের ফলাফল জানা যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement
সরকারি চাকরির নতুন বয়সসীমাতে সন্তুষ্ট নন আন্দোলনকারীরা রাজশাহী থেকে কৃষিপণ্য পরিবহনে চালু হচ্ছে স্পেশাল ট্রেন গাজীপুরে ফের পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ারের মৃত্যুবার্ষিকীতে মানুষের ঢল নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা সরকারি চাকরি পাবেন না : ক্রীড়া উপদেষ্টা সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলায় গ্রেফতার ২৬ জনই ছাত্রলীগের সাথে জড়িত : ডিএমপি খাগড়াছড়িতে এক ভারতীয় নাগরিকসহ আটক ২ বরিশালে ঘূর্ণিঝড় দানা মোকাবিলায় প্রস্তুত ৫৪১ আশ্রয়কেন্দ্র দেওয়ানগঞ্জে ৩ সন্তানের মায়ের আত্মহত্যা কাদিয়ানীদেরকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে : হেফাজত আইআরআই প্রতিনিধিদলের সাথে গণঅধিকার পরিষদের বৈঠক

সকল