০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

বিমানবন্দরের হর্নমুক্ত ঘোষিত এলাকায় বেজেই চলেছে হর্ন!

- ছবি - ইন্টারনেট

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকাসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং আগের মতই বাজছে হর্ন।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এর বিধি-৪ অনুযায়ী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সম্মুখস্থ এলাকা ও তার উত্তর-দক্ষিণে দেড় কিলোমিটার (স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে হোটেল লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত) এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণার নির্দেশ দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

নির্দেশনায় বলা হয়, ১ অক্টোবর থেকে ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ওই এলাকায় গাড়ির হর্ন বাজানো নিষেধ এবং হর্ন বাজালে কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে।

সে অনুযায়ী বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), পরিবেশ অধিদফতর, সড়ক বিভাগ, পরিবহন মালিক সমিতিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

সরেজমিনে যা দেখা যায়, দক্ষিণে লা মেরিডিয়ান পয়েন্টের সামনে নীরব এলাকার শুরু হয়েছে এমন লেখাযুক্ত বিভিন্ন বোর্ড রয়েছে। একইভাবে উত্তরার স্কলাস্টিকা পয়েন্ট এলাকার ফুটপাতের ওপর একটি স্টিলের খুঁটিতে টাঙানো বোর্ডে লেখা ‘নীরব এলাকা শুরু: ঢাকা সড়ক বিভাগ’। কিন্তু এসব এলাকায় সড়কের কোথাও হর্ন ছাড়া গাড়ি চলতে দেখা যায়নি।

গত বৃহস্পতিবার রাত ও পরদিন শুক্রবার দিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এ নিয়ম মানছে না কেউ। যে যেভাবে পারছে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজিয়েই চলেছে। বেশি হর্ন বাজাচ্ছে বাস-মোটরসাইকেল। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ তৈরি করে বাজানো হচ্ছে হর্ন। সেখানে তদারকি বা মনিটরিং করার মতে কাউকেও দেখা যায়নি।

যাত্রী ও স্থানীয়দের অভিযোগ-

স্থানীয় লোকজন, যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত ১ অক্টোবর নীরব এলাকা কর্মসূচি উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত শব্দদূষণে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই কারণে-অকারণে হর্ন বাজিয়ে চলছেন চালকরা। তাই আইনের প্রয়োগ ছাড়া এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় মেইন সড়কে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হর্ন যার যার ইচ্ছেমতোই বাজিয়ে চলছে। বাস-কার-মোটরসাইকেল সবাই প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজাচ্ছে। কেউ দেখার নেই। ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু কোনো জরিমানা করতে দেখলাম না।

হর্ন বাজানো এই এলাকা নিষিদ্ধ, এখন আগের মতো হর্নের শব্দ শুনেন কি না, লা মেরিডিয়ান হোটেল সামনে দায়িত্বরত সিকিউরিটির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হর্ন আগের মতোই যে যার মতো প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে বাজিয়েই চলছে, বাস-ট্রাক ও মোটরসাইকেল বেশি হর্ন দিতেই থাকে।

চালকদের দাবি-

এ বিষয়ে চালকদের দাবি, ঢাকা শহরে হর্ন ছাড়া যানবাহন চালানো সম্ভব নয়। কারণ সড়কে পথচারীরা ট্রাফিক শৃঙ্খলা মানেন না। আবার সড়কের কোথাও জেব্রা ক্রসিং বা ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। ফলে যত্রতত্র সড়ক পার হন পথচারীরা। এমন পরিস্থিতিতে হর্ন না দিলে দুর্ঘটনা আরো বাড়বে।

বাস স্টপে থামা অবস্থায় কয়েকজন চালকের সাথে কথা হলে জানা যায়, এই এলাকা হর্নমুক্ত বা নীরব এলাকা ঘোষণা করছে সেটি তারা জানেন না। হর্ন ছাড়া বাস চালানো যায় না কি উল্টা প্রশ্ন রাখেন।

চালকদের দাবি, মানুষজন ইচ্ছেমতো রাস্তা পার হয়, হঠাৎ সামনে মোটরসাইকেল পড়ে যায়, তখন হর্ন না বাজালে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে, তাই হর্ন বাজাতে হয়। তবে রাস্তায় সবাই সচেতন থাকলে হয়তো হর্ন কম বাজালেও চলবে।

হর্ন বাজালে জরিমানা কত জানতে চাইলে চালকরা সঠিক কোনো তথ্য বলতে পারেনি।

পরিবেশ অধিদফতরের ঘোষিত নীরব এলাকাগুলো হলো-

এর আগে পরিবেশ অধিদফতর সারাদেশে ১২টি নীরব এলাকা ঘোষণা করে। ঢাকায় পাঁচটি নীরব এলাকা রয়েছে। সবশেষ যুক্ত হয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা। আগে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয় সচিবালয়, আগারগাঁও, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকা।

গবেষণায় দেখা যায়-

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকার কোনোটিতেই আইন অনুযায়ী ‘নীরব এলাকা’ বাস্তবায়ন হয়নি। সবগুলোতেই শব্দের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, নীরব এলাকা সচিবালয়ের ১২টি লোকেশনে শব্দের মাত্রা গড়ে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবেল। জাতীয় সংসদ এলাকায় ৭১ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এলাকায় ৭৫ দশমিক ৫৮ ডেসিবেল ও আগারগাঁও এলাকায় ৭২ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল।

এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান ইউএনবিকে বলেন, হর্ন বন্ধ করতে হলে আগে মানুষ, চালক ও গাড়ির মালিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পরে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারলে হর্ন বন্ধ করা সম্ভব। যেহেতু শব্দদূষণের অন্যতম উৎস হলো হর্ন, এটি বন্ধ করতে পারলেই ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ শব্দদূষণ কমে যাবে। কিন্তু এটি বন্ধ করার জন্য আইনগত যে ভিত্তি রয়েছে সেটি দুর্বল।

তিনি আরোবলেন, আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী পুরো ঢাকা শহরই নীরব এলাকা। কোথাও হর্ন দেয়া যাবে না। আইন প্রয়োগ করতে গেলে এটা একটা বড় সীমাবদ্ধতা। শব্দদূষণ রোধে আমাদের যে দু’টি আইন রয়েছে সেটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এছাড়া আইন অনুযায়ী স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ এলাকায় ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা আছে।

হর্ন নিয়ে আইনে কি আছে-

শব্দদূষণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।

এই আইনে শাস্তি হিসেবে বলা আছে, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো: মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া ইউএনবিকে জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং এর সামনের তিন কিলোমিটার মহাসড়ক হর্নমুক্ত ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিমানবন্দরের উত্তরে স্কলাস্টিকা পয়েন্ট থেকে দক্ষিণে লা মেরিডিয়ান পয়েন্ট পর্যন্ত নীরব এলাকা। সবাই সচেতন থাকলে হর্নমুক্ত এলাকা হিসেবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে চালক ও গাড়ির মালিকসহ সবার সচেতন সহযোগিতা দরকার।

তিনি আরো বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং আশপাশের এলাকায় শব্দদূষণ রোধে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়নের নানা কার্যক্রম চালিয়েছে বেবিচক ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

সূত্র : ইউএনবি


আরো সংবাদ



premium cement