নিউজিল্যান্ডের শিক্ষা ও ভারতের সহিংসতা
- মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ
- ০৫ মার্চ ২০২০, ০০:০০
ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পরাশক্তি ভারত নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিল পূর্ণাঙ্গ একটি সিরিজ খেলতে। প্রথমে টি-২০ সিরিজে তারা ৫-০ তে হোয়াইট ওয়াশ করে স্বাগতিকদের। এর পরই ওয়ানডেতে ৩-০ এবং টেস্টে ২-০ তে হেরে পুরোপুরি লেজেগোবরে হয়ে যায় বিরাট কোহলির দল।
খেলার শেষাংশের ফলাফল যেন পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে দুই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও। যদিও দুই দেশ এমন কোনো অবস্থানে নেই যেখানে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু গত এক বছরে দুই দেশে এমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে যাতে সুনামের সাথে উতরে গেছে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু একই ধরনের পরিস্থিতিতে শুধু ঘৃণাই কুড়িয়েছে ভারত।
আসামের এনআরসি, জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, নাগরিকত্ব সংশোধন বিল ইত্যাদির একটি বিষয়েও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন তো পায়ইনি, বরং প্রত্যেকটি বিষয়ই ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। আর এসব বিষয়ে যে কেবল জনগণের পক্ষ থেকে বাধা এসেছে তা নয়, বরং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভাও ব্যাপকভাবে এর বিরোধিতা করেছে। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন অনেক রাজ্যের বিধায়ক, মুখ্যমন্ত্রীরাও। সমালোচনায় পিছিয়ে ছিলেন না সুশীল সমাজও। সর্বব্যাপী এ বিক্ষোভে জান-মাল ক্ষয়ের ইস্যুগুলো যেন ছিল স্বাভাবিক বিষয়। তবে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এতে দমে যায়নি, নিজেদের ঘোষণাগুলো তারা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেছে, পাস করিয়ে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট থেকেও। ফলে পরবর্তী সময়ে আইনের পক্ষ নিয়ে জনমত দমন আরো সহজ হয়ে গেছে মোদি সরকারের পক্ষে। এতে কোনো কিছুরই পরোয়া করেনি তারা।
একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে দিল্লির সাম্প্রতিক হামলার ক্ষেত্রেও। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে দিল্লি যেন পরিণত হয় মুসলিম সংহার কেন্দ্রে। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী (সিএএ) আইনকে কেন্দ্র করে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে দিল্লির উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে এখন পর্যন্ত ৪৭ জন প্রাণ হারানোর কথা জানা গেছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো সাত শতাধিক মানুষ। আহতের সংখ্যাও ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। দিল্লির বিভিন্ন গলির ড্রেনে এখনো পাওয়া যাচ্ছে লাশ। পচে গলে যাওয়া এসব লাশ শনাক্তও করা যাচ্ছে না।
বিজেপির এক নেতার ডাকে ছড়িয়ে পড়া অশান্তিতে টানা কয়েক দিন দিল্লির পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। উগ্রবাদী হিন্দুরা বন্দুক, রড, লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়েছে। মূল সংঘর্ষ হয় মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব দিল্লির ভজনপুরা, মৌজপুর, কারাওয়াল, ব্রহ্মপুরী ও মুস্তফাবাদ নগরে। আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে কয়েক শ’ বাড়ি ও দোকানে। উন্মত্ত জনতার হাতে প্রাণ ঝরে গেছে অনেক। ভাঙচুর হয়েছে তিন শতাধিক গাড়িও। অগ্নিসংযোগ, গুলিবর্ষণ ও সংঘর্ষের পাশাপাশি মুসলিমদের ওপর চালানো হয় এসিড হামলা। কাউকে সন্দেহ হলে বিবস্ত্র করে নিশ্চিত করা হয়েছে ধর্মপরিচয়। প্রকাশ্য রাজপথে হামলা করে মেরে ফেলা হয়েছে অনেক মুসলমানকে।
গভীর রাতে হাজার হাজার যুবক মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে এবং হাতে বন্দুক ও ধারালো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের হামলা করে। এলাকাতে ঢুকেই তারা মারধর শুরু করে সেখানকার বাসিন্দাদের। ঘরে ঘরে ঢুকে শুরু করে লুটপাট। তারপর একটা একটা করে বাড়িতে আগুন লাগাতে থাকে। এভাবে মহল্লার পর মহল্লা জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ওই হামলার পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে সবাই এলাকা ছেড়ে চলে যান।
কিন্তু দিল্লির পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল ভারতীয় পুলিশ। হামলা শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের কাছে ছয় দফা সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল গোয়েন্দা বিভাগ। নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। তারপরও পুলিশি ব্যর্থতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দিল্লি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়েছিল দিল্লি হাইকোর্টও। কিন্তু মুরলিধর নামের যে বিচারপতি এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন ওই রাতেই তাকে বদলি করে তার এই প্রচেষ্টার যথাযথ প্রতিদান দেয় মোদি সরকার।
দিল্লি প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সহিংসতা রোধ করার চেষ্টার দাবি করলেও তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। দিল্লি পুলিশ কোনোভাবেই এ সহিংসতা দমাতে এগিয়ে আসেনি। বরং মসজিদে আগুন দেয়া, মুসলিম যুবকদের নির্যাতন করাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছে খোদ পুলিশই। পরে এক খবরে প্রকাশ পায়, চারদিন ধরে চলা এ সহিংসতা থামাতে দিল্লি পুলিশের কাছে ১৩ হাজার ২০০ ফোন গিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোতে সাড়া দেয়ার মতো কারণ খুঁজে পায়নি তারা। উগ্রবাদী হিন্দুদের চালানো এ সহিংসতার একপর্যায়ে দিল্লি হাইকোর্ট উসকানিমূলক ভাষণ দেয়ার কারণে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, স্থানীয় নেতা কপিল মিশ্রসহ চার নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো এফআইআর দায়ের না করে দিল্লি পুলিশ আদালতে জানিয়ে দেয়, দিল্লির যা পরিস্থিতি তাতে এফআইআর করলে, তা শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হবে না।
জাতিসঙ্ঘ, ওআইসির মতো শীর্ষস্থানীয় সংস্থা ভারতের এ পরিস্থিতির নিন্দা জানালেও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বারবারই দাবি করছে, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। অথচ সদ্য সফর করে যাওয়া ট্রাম্পের দেশ থেকেই এসেছে ভিন্নমত। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মার্কিন কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) বলেছে, দিল্লিতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে বেছে বেছে মুসলিমদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।
কিন্তু এত কিছুতেও মোদির কিছুই আসে যায়নি। দিল্লি যখন পুড়ে ছারখার হচ্ছে, তখন তিনি বিশেষ অতিথির সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। অন্তত দুই পক্ষকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানাতেও তার লেগে যায় চারটি দিন। অথচ বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রযুক্তিপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেকোনো ঘটনায় দ্রুত টুইট করার অজস্র প্রমাণ তার আছে।
প্রায় এক বছর আগে পুরোপুরি ভিন্ন একটি পরিস্থিতি দেখেছিল বিশ্ববাসী। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে বর্বর হামলা চালিয়েছিল উগ্রবাদী এক খ্রিষ্টান ব্রেন্ডন ট্যারেন্ট। জুমার নামাজের আগ মুহূর্তে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে হামলা চালিয়ে ৫৯ জন মুসল্লিকে হত্যা করেছিল সে। শান্তিপ্রিয় নিউজিল্যান্ডে এমন ঘটনায় আঁতকে উঠেছিল পুরো বিশ্ব। সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের আশঙ্কাও জেগে উঠেছিল অনেকের মনে। কিন্তু সে সময়ে প্রেক্ষাপটে হাজির হয়েছিলেন বিশ্ব দরবারে প্রায় অপরিচিত নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন, যার বছর চল্লিশও পেরোয়নি। কিন্তু নিজের আন্তরিকতা, প্রজ্ঞা দিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে এনেছিলেন। ওই হত্যাকাণ্ডের জেরে পুরো দেশে আর একটিও গুলি বর্ষিত হয়নি, কোথাও পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়নি। সে সময় গালভরা বুলি যেমন উচ্চারণ করেননি তিনি, তেমনি কোথাও মায়াকান্নাও কাঁদেননি। তারপরও তার তথাকথিত অসুন্দর চেহারাই সুন্দর হয়ে ভেসেছে বিশ্বমানুষের অন্তরে। তার সহজ-সরল কথাগুলোই দাগ কেটেছে সবার মনে। মসজিদে গিয়ে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, পার্লামেন্টে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন মুসলমানদের সাথে, বারবার খোঁজ নিয়েছেন নিজে গিয়ে। ফলে তার আন্তরিকতায় ঘাটতি পায়নি কেউই। দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধীর বিচার করেছেন, আবার যে ধরনের অস্ত্র দিয়ে হামলাকারী হামলা চালিয়েছিল, পুরো দেশ থেকে সে ধরনের সব অস্ত্র তুলে নিয়ে জেসিন্ডা প্রমাণ করেছিলেন, আসলেই তিনি শান্তির পক্ষে। তার এই প্রচেষ্টাগুলোকে সম্মান জানিয়েছিল সারা বিশ্বের মানুষ। এমনকি তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। নোবেল হয়তো পাননি তিনি, কিন্তু কোটি মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। তার প্রশংসা করে দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মেদ বিন রশিদ আল-মাকতুম টুইটারে লিখেছেন, ‘বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলিমদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলিমের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিয়েছেন।’
একই বছরে বিশ্বকাপ ফাইনালের মাঠে যে পরিস্থিতিতে পরাজয় মেনে নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল কিউই ক্রিকেটাররা, তার নজিরও বিরল। এ দুটি ঘটনাই প্রমাণ করেছিলÑ দেশ হিসেবে, মানুষ হিসেবে তারা কত উচ্চমানের।
মার্চের ওই ঘটনা যেভাবে সামলেছিলেন জেসিন্ডা আরডার্ন, তাতে বিশ্বের বিখ্যাত পত্রিকার বাঘা বাঘা সম্পাদকরা মন্তব্য করেছিলেন, জেসিন্ডার কাছ থেকে বিশ্ব নেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে। রাজনীতিতে অপরিপক্ব হতে পারেন, কিন্তু মানবিকতায় তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। কিন্তু তাদের সে উপদেশ বা পরামর্শ যেকোনো কাজে আসেনি, মোদির সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্তই তার প্রমাণ। হ