২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আফগানিস্তানে কি শান্তি ফিরে আসবে

-

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষীণ আলোক রেখা ফুটে উঠেছে। সত্যিই কী দেশটিতে শান্তি ফিরে আসবে? হ্যাঁ শান্তি ফিরে আসার ব্যাপারে নতুন করে আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে। দীর্ঘদিনের সঙ্ঘাত ও সহিংসতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আফগানিস্তানে বহুপ্রত্যাশিত যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে শান্তি চুক্তিতে পৌঁছার আশা নিয়ে দেশটির সরকারি বাহিনী ও আমেরিকার সাথে গত শনিবার থেকে এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়।
২০০১ সাল থেকে যুদ্ধ ছাড়া একটা দিনও আফগানরা দেখেনি। দক্ষিণ এশিয়ার এই মুসলিম দেশটিতে এত দিন ধরে প্রতি মুহূর্তে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর বিমান ও ড্রোন হামলা এবং এর জবাবে তালেবান গেরিলাদের আত্মঘাতী হামলা অব্যাহত ছিল। দুই পক্ষের হামলা ও পাল্টা হামলায় দেশটিতে প্রতিদিনই রক্তপাত ও মৃত্যুর মিছিল স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। টানা ২০ বছর ধরে দেশটিতে এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। এতে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের জানমাল ইজ্জত আব্রু সবকিছু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দু’দণ্ড শান্তি ফিরে আসার স্বপ্ন দেখাও তারা ভুলে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শান্তির দেখা পেয়েছে।
আফগানিস্তানে ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে। বহু মানুষ রাস্তায় নেমে নেচে গেয়ে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। শনিবার সকালেই যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের রাস্তায় টেক্সিচালক হাবিবউল্লাহ বলেন, ‘এই প্রথম কোনো সকাল এল, যখন আমি বোমা বা আত্মঘাতী হামলায় মারা যাওয়ার ভয় ছাড়াই বাইরে বের হয়েছি। আমি আশা করি, এই শান্তি এখন থেকে যেন চিরদিন তথা সারা জীবন থাকে।
আফগানিস্তানে তালেবানদের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ কান্দাহার ও পূর্বাঞ্চলীয় জালালাবাদে এরই মধ্যে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যবাহী পশতুন নাচগানে যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। ত্রিপক্ষীয় এই বোঝাপড়ার উদ্যোগ সত্যিকারভাবে কার্যকর হলে ২০০১ সালের পর এটা হবে তালেবানদের সাথে দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধবিরতির কোনো ঘটনা। এই যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন এবং তালেবানদের মধ্যে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে যার চূড়ান্ত পরিণতিতে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমেরিকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে সহিংসতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতা অনুসারে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী চলতি সপ্তাহে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকবে। আর তালেবানরা সহিংসতা বন্ধ করা সংক্রান্ত নিজেদের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউ ইয়র্ক নগরীতে অবস্থিত টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ হামলার ফলে আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোর সামরিক বাহিনী তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে। আফগানিস্তানকে ‘সাম্রাজ্যবাদের কবর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিহাসের শিক্ষাকে অবজ্ঞা করে ১৯৭৯ সালে আগ্রাসন চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করলেও দীর্ঘ ১০ বছর আফগান জিহাদের মোকাবেলা করে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে টিকতে না পেরে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ডম্যাক মিলান উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, রাজনীতির প্রথম নির্দেশ হলো, ‘আফগানিস্তান আক্রমণ বা দখল করো না।’ কিন্তু ৯/১১ ট্র্যাজেডি পর ২০০০ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে আমেরিকা আগ্রাসন চালায়। আশা করা হয়েছিল, আমেরিকা তাদের প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং থিঙ্ক ট্যাংকের উপদেশ মেনে আফগানিস্তানের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই আশা মরীচিকায় পরিণত হয়। দৃশ্যত, আমেরিকার সহজ জয়ে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে ওয়াশিংটন গর্ব ও অহঙ্কারে ফেটে পড়েছিল। ফলে তারা আফগান ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে যায় এবং আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে সেখানে ১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে আটকা পড়ে থাকে। আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধে বর্তমান বিশ্বের এই একক পরাশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধে তাদের শত শত কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং হাজার হাজার মার্কিন সেনা জীবন দিয়েছে। আফগান যুদ্ধে শুধু গত বছরই ১০ হাজারের বেশি বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। আফগানিস্তানে জাতিসঙ্ঘের সহায়ক মিশনের তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালে দেশটিতে তিন হাজার ৪০৪ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ছয় হাজার ৯৮৯ জন। ছয় বছর ধরেই আফগানিস্তানে প্রতিবছর ১০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের সহায়ক মিশন (ইউএনএএমএ)। মিশনের প্রধান তাদামিচি ইয়ামামোতো বলেন, দেশটিতে চলমান সহিংসতায় দেশের প্রায় প্রতিটি লোকই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যুদ্ধ থামানো অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে।
আফগানিস্তানে বর্তমানে আমেরিকা ও পশ্চিমা সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে গোটা আফগানিস্তানে তালেবানদের শক্তিমত্তা ও নিয়ন্ত্রণ অপরিসীম। ধর্মের প্রতি অনুগত ও অধিকতর রক্ষণশীল আফগান সমাজে আমেরিকা ও কাবুল সরকার পশ্চিমা মূল্যবোধ চাপিয়ে দেয়ার কারণে আমেরিকা ও তাদের সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ। দেশটির অধিকাংশ মানুষ পশতুন-আর বেশির ভাগ তালেবানও হচ্ছে পশতুন জাতিগোষ্ঠীর। অপর দিকে আমেরিকা সমর্থিত কাবুল সরকার কেবল তাজিক, হাজারা ও উজবেক গোষ্ঠীর লোকদের রাখেন। আমেরিকা এতদিন তালেবানদের সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে তাদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় না এসে ভুল করেছে। এখন তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
তালেবানদের সাথে এক বছরের বেশি সময় ধরে আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান যুদ্ধবিরতি সফল হলে ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহার বহুল কাক্সিক্ষত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও জানিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার পর তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লা মুজাহিদও অগ্রগতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, উভয় পক্ষই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তাদের সিনিয়র নেতাদের আমন্ত্রণ জানাবে। তালেবানদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার পর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
খসড়া চুক্তির শর্তানুসারে তালেবানদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং আফগান সরকারের সাথে শান্তি আলোচনার প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। বিনিময়ে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করবে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সপ্তাহটা ভালোভাবে পার হলে বোঝা যাবেÑ তালেবানরা তাদের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং শান্তি চুক্তিকে সামনে রেখে আস্থা প্রদর্শন করতে পারে। বিশ্লেষকদের অভিমত, চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দীর্ঘ ১৮ বছরের বেশি সময় পর আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে পারে। তবে দুর্বল অর্থনীতির দেশটি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা দিতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
আফগানিস্তানে অবশেষে শান্তি ফিরে আসুক, এটাই সবার কাম্য। তবে আমেরিকা, তালেবান এবং আফগানিস্তানের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বাস্তবসম্মত সমঝোতায় পৌঁছবে এটাই পর্যবেক্ষক মহল আশা করে। আফগানিস্তানের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য। ’৯০-এর দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে আফগান শান্তি চুক্তিতে প্রতিবেশী দেশ বিশেষত, পাকিস্তান ও ইরানের সমর্থন অবশ্যই থাকতে হবে। সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো বৃহৎ শক্তিগুলোর আশীর্বাদ থাকলে শান্তিচুক্তি কার্যকর ও আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে সহায়ক হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement