২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দক্ষিণ সুদানে শান্তির আভাস

-

পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদান। বিশ্বের নবীনতম এ রাষ্ট্র জন্মের পর থেকেই সমস্যায় জর্জরিত। প্রবীণ নেতারা যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তারা এখন একে অপরের সাথে লড়াই ও ব্যর্থ আলোচনার জন্য বেশি বিখ্যাত। ২০১১ সালে একটি গণভোটে ৯৮.৮৩ শতাংশ মানুষ স্বাধীন দক্ষিণ সুদানের পক্ষে মত দেন। এরপর ওই বছর ৯ জুলাই সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার দুই বছর পরে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশটি।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দ্য সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্ষমতার প্রশ্নে দলে বিভক্তি দেখা দেয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট সালভা কির তার ডেপুটি প্রেসিডেন্ট রিক মাচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের পরই মূলত সঙ্কটের সূত্রপাত।
তখন থেকেই বিভিন্ন কারণে দুই গ্রুপের অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে সালভা কিরের সম্প্রদায় দিনকা ও মাচারের ন্যুয়ের সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাদের মধ্যে চলতে থাকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এই সহিংসতার শিকার হয়ে চার লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। জাতিসঙ্ঘের ঘাঁটিগুলো পরিণত হয় বিশাল শরণার্থী শিবিরে। প্রাণভয়ে দেশটির প্রায় ৪০ লাখ মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকবার সমঝোতার লক্ষ্যে বৈঠকে বসলেও শান্তির দেখা মেলেনি। দিন দিন বাড়তে থাকে সহিংসতা।
২০১৫ সালে সালভা কির দেশের প্রদেশ ১০টি থেকে বাড়িয়ে প্রথমে ২৮টি করেন। এরপর সেটিকে বাড়িয়ে ৩২-এ নিয়ে যান। ২০১৫ সালের আগস্টে শান্তির লক্ষ্যে একসাথে বসলেও ফলপ্রসূ কোনো সমাধান আসেনি। ২০১৬ সালের এপ্রিলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি জোট সরকার গঠিত হলেও রাজধানী জুবায় সংঘর্ষ শুরু হলে রিক মাচার দেশ ছেড়ে পালান। ফলে কয়েক লাখ লোকের মৃত্যু ও জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি শরণার্থী হয়ে পড়ে।
দক্ষিণ সুদানের বর্তমান পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল। ৯ মাস অপেক্ষার পর দুটি বৈঠক বাতিলের পর সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারি দুই পক্ষের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে একমত হয়। অনেক বিশ্লেষক এটিকে পুরনো শান্তিচুক্তির মতো আবারো ভেঙে যেতে পারে বলে মনে করছেন। যদিও এবারের চুক্তিকে আগের মতো মনে করে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সর্বশেষ শান্তিচুক্তি হওয়ার পর থেকে সহিসংতা কমতে থাকে। বিদ্রোহী জেনারেলরা সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন শহরে যাতায়াত শুরু করে। তারা অঞ্চলের জনসাধারণের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা পৌঁছাতে শুরু করে।
আশার কথা হলো, মাচার ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনরায় রাজধানী জুবায় আসছেন। সরকার ও বিদ্রোহী বাহিনীর ৮৩ হাজার সদস্য নিয়ে জাতীয় সামরিক বাহিনী গঠন করা হচ্ছে। তিন বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতসব ভালো খবরের পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অব্যাহত চাপ ও আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার হুমকি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট কির ঘোষণা করেন তিনি তার দেশের প্রদেশ সংখ্যা ৩২টি থেকে কমিয়ে ১০টি প্রদেশে রূপান্তর করবেন। শান্তিচুক্তির জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
বিদ্রোহীরা অনেক আগে থেকেই প্রদেশ সংখ্যা কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। এখন সব কিছু ভালোর দিকে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষ শান্তিচুক্তিতে কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপও স্বাক্ষর করেছে যারা এর আগে কোনো শান্তিচুক্তিতে সম্মত হয়নি।
কিন্তু তারপরও সবকিছু এত সহজেই সমাধানে পৌঁছবে বলে মনে হচ্ছে না। মাচারের দাবি অনুযায়ী, শিগগিরই কির ১০ প্রদেশের বিষয়ে সম্মত হতে চাইবে না। কারণ সালভা কির ১০টি প্রদেশের পাশাপাশি তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। যাদের একটি সালভা কিরের জন্মস্থান ও দিনকা সম্প্রদায় অধ্যুষিত রুয়েং প্রদেশ। এই প্রদেশে দক্ষিণ সুদানের ৮০ শতাংশ তেল মজুদ রয়েছে, যা দেশটির একমাত্র রফতানিযোগ্য সম্পদ।
এ ছাড়া গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মাচার সুদানের সার্বভৌম কাউন্সিলের প্রধান লে. জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আবদেল রহমান বোরহানের সাথে জুবায় যান সালভা কিরের সাথে সর্বশেষ চুক্তির বিষয়ে আপস করতে। সেখানে মাচার পুনরায় জুবায় ফিরে এলে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। তিনি ২০১৬ সালে ঘটনার কথা স্মরণ করে নিজের নিরাপত্তার জন্য তিন হাজার সৈন্যের একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাবাহিনী গঠনের কথা বলেন। তিনি জুবায় রাজনৈতিক শক্তির মতো নিজস্ব সেনাবাহিনীর দাবি করেন।
সরকার যদিও যৌথবাহিনী গঠনের দাবি মেনে নিয়েছে, কিন্তু রাজধানী থেকে নিজস্ব বাহিনী সরিয়ে নিতে নারাজ। এ ছাড়া রাজধানী আফ্রিকার সরকারগুলোর নেতৃত্বে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
যত দূর মনে হচ্ছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে একটি সরকার গঠন হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ সরকার কত দিন টিকবে। বিদ্রোহীদের নিয়ে জাতীয় সামরিক বাহিনী গঠন হতে যাচ্ছে। কিন্তু গত ছয় বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দুই গ্রুপ কিভাবে একসাথে কাজ করবে সেটাও এখন ভাবনার বিষয়।
এ পর্যন্ত ১২টির মতো চুক্তি হয়েছে দুই গ্রুপের মধ্যে। তারপরও শান্তির দেখা না মিললেও সর্বশেষ এই শান্তিচুক্তি কী ফল বয়ে আনে তাই এখন দেখার বিষয়। এ শান্তিচুক্তির দিকে তাকিয়ে আছে দক্ষিণ সুদানের হতভাগ্য লাখো নাগরিক। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement