২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বৈষম্য দূরীকরণে তারুণ্যের সফল দ্রোহ

-

স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের আন্দোলন প্রাথমিকভাবে শুরু হয় কোটা সংস্কারের দাবিতে। এটি ছিল মূলত ছাত্রদের আন্দোলন। পরে অবশ্য বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে এটি আপামর জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত দেশে চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ছিল ৫৬ শতাংশ, অর্থাৎ মেধায় নিয়োগ ছিল মাত্র ৪৪ শতাংশ। এই ৪৪ শতাংশের মধ্যে মেধাবীদের চাকরি সুযোগ ছিল সামান্য, কারণ বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস, স্বজনপ্রীতি এবং দলীয় তদবিরের কাছে পেরে উঠত না প্রকৃত মেধাবীরা। ফলে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া তাদের আন্দোলনের ফলে কোটা পুরোপুরি বাদ দেয়া হয় ২০১৮ সালে। পরে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধাভোগীদের হাইকোর্টে রিট পিটিশনের রায়ে ২০১৮ সালে জারি করা কোটা বাতিলের সরকারি পরিপত্র গত ৫ জুন অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত ঘোষণা করেন। এর জেরে ছাত্র-জনতা নতুন করে আন্দোলনে নামে।
প্রথম দিকে সরকার এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয়নি বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। পরে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার আদালতের মাধ্যমে কোটা সংস্কার করে ৯৩ শতাংশ মেধা এবং ৭ শতাংশ কোটা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রশ্ন হলো, কোটার দাবি মানার পরও কেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক নাম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ হলো। কতটা যৌক্তিক ছিল এই নাম? প্রকৃত অর্থেই এই নামটি ছিল অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সমস্যা কেবল কোটায় নয়, বরং সব ক্ষেত্রে বৈষম্য। ফলে বৈষম্যবিরোধী কথাটি বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, হলে বসবাসের সুযোগ এমনকি দেশের সব সেক্টরের সব ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্য বিদ্যমান। উল্লেখযোগ্য কিছু বৈষম্যের চিত্রটা দেখে নিতে পারি।
অর্থনীতিতে বৈষম্য বলতে আমরা বুঝি ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদ এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বড় ধরণের তফাত। অর্থাৎ সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন হয় না। এ অবস্থা মূলত পুঁজিবাদের ফসল। সম্পদের অভাবে নয়, প্রকৃতপক্ষে সুষম বণ্টনের অভাবেই এই বৈষম্য তৈরি হয়। দেশের আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করার অন্যতম প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে গিনি সহগ (Gini coefficient)। গিনি সহগের এই মাত্রার সাথে আয়ের সরাসরি সম্পর্ক। অর্থাৎ সহগের মাত্রা যত বেশি, বৈষম্য তত বেশি। বর্তমান পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিনি সহগ দক্ষিণ আফ্রিকায় (৬১)। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, গিনি সহগ ছিল ৩৬ মাত্র। অথচ ২০২২ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিউচার সার্ভে অনুযায়ী গিনি সহগ ৪৯ দশমিক ৯-এ পৌঁছেছে। গিনি সহগ ৫০ মানে দেশ উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। দুই বছর পরে ২০২৪ সালে এসে এই গিনি সহগ কত হলো সেটি জানা যায়নি ঠিক, তবে দেশের আপামর জনসাধারণের আয়ে একটি চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা হয়েছে মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। এমনকি সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে লুটপাট, অর্থ পাচার তো রয়েছেই। পুঁজিবাজার ও ব্যাংক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব্যাংকে টাকা রেখেও মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না। একদিকে এই লুটপাটকারীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা মুখে কাপড় গুঁজে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধরছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলদেশের মান দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে, অর্থনীতির সব সূচকে দেশটি বিশ্বের র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে। দেশটি বিশ্বমানচিত্র থেকে যেন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও ছাত্রদের রয়েছে চরম বৈষম্য। কোটার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে অনেক বঞ্চনার চাপা দীর্ঘশ্বাস। ছাত্ররা যোগ্যতা থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পায় না। মানসম্মত খাওয়া নেই, লাইব্রেরিতে পড়ার জায়গা নেই, বই নেই, গণরুম নামক বন্দিশালায় সরকারদলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের শর্তে জায়গা পাওয়া, বড় ভাইদের সম্মান করার পদ্ধতি শিখতে গিয়ে মাঝে মধ্যে থেরাপির শিকার ইত্যাদি তো রয়েছে। পদে পদে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সরকার দলের ছাত্রদের কাছে। নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন তারা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এত কিছু মেনে নিয়েও তারা আশায় বুক বাঁধেন চাকরি নামক সোনার হরিণের জন্য। কোটার নামে সে আশায় যখন গুড়েবালি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তখন তারা বসে থাকতে পারেননি।
ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের মৌলিক অধিকার যা থেকে তারা বঞ্চিত গত দেড় দশক ধরে। ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের পছন্দের জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়া প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। অথচ গত ১৫ বছর ধরে এই অধিকার তারা প্রয়োগ করতে পারছে না। ফলে একটি স্বৈরাচারী শাসক এবং তার দলীয় ক্যাডার বাহিনীর যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম সাধারণ ছাত্রদের। উপায় না পেয়ে অনেক সামর্থ্যবান মেধাবী তরুণ দেশ ছাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ তরুণ দেশ ছাড়ছে অথবা ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ দেশের বিত্তহীন সাধারণ মেধাবী তরুণরা দেশে থেকে যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। এতটা বৈষম্য কারও পক্ষেই মেনে নেয়া অসম্ভব।
দেশের মানুষের জীবন কেবল চাকরি করার জন্য নয়; বরং তার সার্বিক কল্যাণ, যেমন, জীবনযাত্রার মান, সম্মান-মর্যাদা, বাকস্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্বও দেশের ছাত্র-জনতা এবং তরুণ সমাজের ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশকে আমরা যারা জানি, এ দেশের জনগণ দীর্ঘদিন অন্যায় মেনে নেয় না। একসময় প্রতিবাদ করে। বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের অভ্যুত্থানে সেটি লক্ষ করেছি। আমরা দেখেছি, মানুষ দীর্ঘদিন সহ্য করে, অপেক্ষা করে, কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তখন বিস্ফোরণ ঘটে। যারা দেশ চালান, দেশের দায়িত্বে থাকেন, তারা যদি মানুষের এই মনোভাব বুঝতে না পারেন, তাহলে বিপত্তি ঘটে। এবারে সেটাই ঘটেছে।
এত কিছুর পরও মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষগুলো মাটি কামড়িয়ে দেশে পড়ে থাকতে চায়। ৯০ শতাংশ মুসলমান তাদের নিজেদের দেশে ধর্মকর্ম করে, রুটিরুজির ব্যবস্থাসহ স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু, দিনে দিনে তাদের ধর্মকর্ম করায়ও নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ আট শতাংশেরও কম ধর্মীয় জনসংখ্যার মানুষকে অবাধে ধর্ম পালনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রধান পদে বসানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশে এমনকি স্কুলের ইসলাম ধর্মেবিষয়ক শিক্ষকও ভিন্ন ধর্মের। পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু ধর্মের নানা অনুষঙ্গ ঢোকানো হয়েছে কোনও রাখঢাক না করেই।
অধিকন্তু, গত ১৫ বছরে এই দেশের সরকার কোনও বিনিময় না পেয়েই পাশের দেশকে এমন কোনো সুবিধা নেই যা দেয়নি। শোনা যায়, সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় রাখার শর্তে দেশের দু’টি নৌপোর্টের দায়িত্ব, দেশের বুকচিরে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত রেল করিডোর দিয়ে মোটামুটি দেশের সার্বভৌমত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। গত ১৫ বছরে তিস্তা নদির পানি চুক্তি করতে না পারায় দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমি প্রায়। অথচ চীনের সাথে প্রাথমিকভাবে করা তিস্তা চুক্তি থেকে সরে এসে, তিস্তা নদীর শোষকদের হাতেই তিস্তা প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়ার চুক্তি করে আসে। এতবড় বৈষম্য এদেশের তরুণসমাজ মানবে কেন?

এত কিছুর পরও এদেশের ছাত্র-জনতাসহ আপামর জনসাধারণ তাদের মুখ বন্ধ থাকতে বাধ্য হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের জুন মাসে মুখ খুলল চাকরির ক্ষেত্রে কোটার বৈষম্য নিয়ে।
শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনকে পাত্তা না দিয়ে দমন-পীড়নে সিদ্ধ সরকার তার নিজস্ব ছাত্র-ক্যাডার, দেশের বিভিন্ন স্তরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনী, আনসার, র্যাব, পুলিশ দিয়ে ব্যাপকভাবে হত্যার পরও দমন করতে না পেরে শেষপর্যন্ত দেশের সেনবাহিনীকে তলব করে, কারফিউ জারি করে ‘দেখামাত্র গুলির’ অনুমতি দিয়ে। হত্যা, গুম, খুন, নির্বিচারে গণগ্রেফতার করতে থাকে।
এত দমন-পীড়নের পরে কোটা আন্দোলন আর কোটায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। কোটাবৈষম্য থেকে দেশের সব সেক্টরের বৈষম্যে সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক নাম দেয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। সরকারি চাকরিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রাধিকারসহ দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে মানুষের আয়-ব্যয়ের বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বৈষম্য ইত্যাদি সব বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে সর্বস্তরের জনতা আন্দোলনে নামে। সরকারের অনুগত বাহিনীর পাশাপাশি অনুগত মুখপাত্র ও প্রচারমাধ্যম যথারীতি বিরোধীদের দায়ী করে প্রচার চালাতে থাকে। ছাত্র-জনতার হত্যার চেয়ে মেট্রোরেল আর বিটিভির ক্ষয়ক্ষতি যেন তাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ বলে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ তো সরকারের সাথে মিডিয়ার আদর্শ।
উল্লেখ্য, এই সরকার ক্ষমতায় এসেই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য সময় সময় গণহত্যার আশ্রয় নিয়েছে। ২০০৯ সালের পিলখানায় গণহত্যা, শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের হেফাজতের আলেমদের গণহত্যা; ২০১৩ সালে একজন মাওলানার ফাঁসির রায় ঘিরে গণহত্যা ইত্যাদি মাত্র কয়েকটি উদাহরণ। এর সাথে ২০২৪ সালের গণহত্যা যোগ হয়েছে। পরিসংখ্যান বলে, চীনের তিয়েন আনমেন স্কয়ারের ব্যাপক ছাত্র হত্যার পরে বিশ্বের ইতিহাসে ২০২৪ সালের গণহতা দ্বিতীয় বৃহত্তম। এ গণহত্যা যেন একাত্তরের ২৫ মার্চের পাক হানাদারদের বর্বর হত্যাকে হার মানিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের নির্বিচার হত্যা, তুলে নিয়ে যাওয়া ও নির্যাতনের কারণে ছাত্রদের আন্দোলন এক পর্যায়ে ‘দ্রোহযাত্রায়’ রূপ নেয়। তাদের অনমনীয় দৃঢ়তার মুখে শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। এখন গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সহায় হোন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement