৫ নবীর নিদর্শন সম্বলিত প্রফেট হাউজ
- রফিকুল হায়দার ফরহাদ, ইস্তানবুল, তুরস্ক থেকে
- ২২ আগস্ট ২০২২, ১৮:৩২
‘ভাই অবশ্যই তোপকপি প্যালেসে যাবেন। সেখানে মূসা আ:-এর বিখ্যাত লাঠিটি আছে। টিকিট কিন্তু ৪৫০ লিরা (টাকায় সাড়ে তিন হাজার টাকা)।’ মূসা আ:-এর ওই লাঠিটি ইস্তানবুলে এসে দেখবো না এটা কি ঠিক। আল্লাহর নির্দেশে যে লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানি দু‘ভাগ হয়ে রাস্তা তৈরি হয়েছিল, যে লাঠি মাটিতে রাখলে সাপ হয়ে যেত, এতো কাছে এসে কেন সেই নিদর্শন স্বচক্ষে দেখতে যাব না। তাই তুরস্ক প্রবাসী বাংলাদেশী হাফিজুল ইসলামের কাছে তথ্যটি পেয়ে টাকার চিন্তা আর মাথায় নেয়নি। লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে তোপকাপি প্যালেসের যাদুঘর অংশে প্রফেট হাউজে (নবীর ঘর) ঢুকে তো রীতি মতো বিস্মিত। শুধু মূসা আ:-এর লাঠি নয়, এই ঘরে সংরক্ষিত আছে মহানবী হযরত মোহাম্মদ স:-এর পানি খাওয়ার বাটি, দাঁড়ি, দাঁত, যুদ্ধে ব্যবহৃত তরবারী, তরবারীর খাপ, তীর ছোঁড়ার ধনুক। সেই সাথে হযরত দাউদ আ:-এর তরবারী।
উল্লেখ্য, পৃথিবীতে দাউদ আ: কে-ই আল্লাহ তায়াল প্রথম শিখিয়েছেন লোহার ব্যবহার। অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় মিশর থেকে ইস্তানম্বুলে নিয়ে আসা হয় নবী ও খলিফাদের ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো।
তুরস্কের সাবেক রাজধানী ইস্তানবুল। অটোম্যান বা উসমানীয় সালতানাতের সময় বসফরাস প্রণালীর দু’প্রান্তে অবস্থিত এই ইস্তানবুল ছিল দেশটির রাজধানী। পরে রাজধানী আংকারায় স্থানান্তরিত হয়। এই ইস্তানবুলের ফাতি জেলায় অবস্থিত তোপকাপি প্যালেস ও জাদুঘর। মেট্রো বা বাসে নামতে হবে সুলতান আহমেদ স্টেশনে। সেখানেই পাশাপাশি অবস্থিত সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদ, হাজিয়া সোফিয়া মসজিদ এবং তোপকাপি প্যালেস ও জাদুঘর। একে বারেই বসফরাস প্রণালী লাগোয়া এই তোপকাপি প্যালেসের অবস্থান। তুর্কি সেনাপতি ফাতি জয় করে ছিলেন এই হাজিয়া সোফিয়া। তাই তার নামে এই জেলা। তোপকাপি মানে কামানের গেট। ১৫ ও ১৬ শতকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রধান কার্যালয় এবং সম্রাটের বাসস্থান ছিল এখানে।
জাদুঘরে অটোম্যান সুলতান আহমেদের সিংহাসন, তার সভাকক্ষ আছে। তবে যত কড়াকড়ি ‘নবীর ঘরে’ প্রবেশের সময়ই। প্রবেশ পথেই তুর্কি নিরাপত্তা রক্ষীদের উচ্চস্বরে বারবার ঘোষণা, ‘কোনো ছবি তোলা যাবে না। করা যাবে না ভিডিও।’ সেই সাথে কাউকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও দেয় না এক স্থানে। পাশাপাশি খেয়াল রাখছে কেউ ছবি তুলছে কিনা।
প্রফেট হাউজে প্রবেশের সময় সব নারীকে মাথায় ওড়না দিতে হবে। কারো ওড়না না থাকলেও সমস্যা নেই। প্রবেশ পথেই রাখা আছে প্রচুর ওড়না। তা মাথায় দিয়ে অন্য গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় তা খুলে জমা দিতে হয়। তবে খুবই দুঃখজনক বিষয় কিছু নারী এমন পোষাকে আসে যা বিব্রতকর। সবার জন্য মাথা ঢাকারই বাধ্যবাদকতা।
প্রফেট হাউজে ঢুকতেই চোখে পড়বে ইমাম হোসেন রা:-এর জামা। যিনি মহানবী স:-এর নাতি এবং হযরত ফাতেমা রা:-এর ছেলে। অনেকটা হাফ শার্ট আদলে সাদা রংয়ের জামা। পাশেই ফাতেমা রা:-এর জামা। ফাতেমা রা:-এর জামার ডান দিকের নিচের অংশ ছিঁড়ে গেছে। অনেকটা সাদা রঙের এই জামা। কাচ দিয়ে ঘেরা জামা দুটি। অন্য সব সরঞ্জামও কাচ দিয়ে ঢাকা। এরপরই বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ এর তরবারী। সাথে আরো দু’সাহাবীর তরবারী।
এরই বাম পাশে রাখা মুসা আ:-এর লাঠি। কালো রংয়ের লাঠিটিতে বেশ কয়েকটি খাঁজ আছে। হালকা বাঁকানো চিকন আকৃতির লাঠিতে ডালের আরেকটি অংশের সংযুক্তি। এর একেবারেই পাশে রাখা দাউদ আ:-এর তরবারি। রয়েছে ইউসুফ আ: ও ইয়াহিয়া আ:-এর একটি নিদর্শন। তবে এই নিদর্শনগুলো কি তা বুঝা যায়নি।
এরপরই মহানবী স:-এর ব্যবহৃত জিনিস। তাঁর পানি পানের বাটির বাইরের অংশ ডিজাইন করা। সাথে আরবী লেখা। ধনুকের সাথে এর খাপও রয়েছে। ধনুকটি সেভাবেই রাখা হলেও খাপটি ডিজাইনে আবৃত। তাঁর তরবাবীর হাতলে ডিজাইন করা এবং তরবারীর খাপেও তাই। তবে তাঁর দাঁড়ি এবং দাঁতের পাত্র এমন ভাবে ডিজাইন করা যে রুমের অল্প আলোর কারনে দাঁড়ি ও দাঁত ঠিকমতো দেখা যায় না। রাখা আছে পায়ের ছাপ। সোনালী রঙের পাত্রের মধ্যে সেই ছাপ। ফলে ছাপটাও সেই রং ধারন করেছে। প্রফেট হাউজে সংরক্ষিত আছে মহানবী স:-এর ব্যবহৃত সিল মোহরও।
এরপর রাখা হয়েছে ইসলামের চার খলিফা হযরত আবু বকর রা:, হযরত ওমর রা:, হযরত উসমান রা: ও হযরত আলী রা:-এর তরবারী। উসমান রা:-এর তরবারী একটু চিকন। আলী রা:-এর তরবারী একটু মোটা আকৃতির। এছাড়া কাবা শরীফের দরজার চাবি এবং একটি কাঠের খুটিও সংরক্ষনে আছে তোপকাপি জাদুঘরে।