‘আয়নাঘরের’ বর্ণনা দিলেন ৫ বছর পর ফিরে আসা মাইকেল চাকমা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:১৪, আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:১৮
পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন।
ঢাকার শ্যামলি থেকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে গোপন বন্দীশালায় আটকে রাখা হয়েছিল, যেটি ‘আয়নাঘর’ নামে অনেকের কাছে পরিচিত।
সেখানে বন্দি থাকার পর গত ৬ আগস্ট তাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেয়া হয়।
বন্দীদশা থেকে ফিরে জানতে পারেন পূত্র শোক বুকে নিয়ে তার বৃদ্ধ বাবা মারা গেছেন। মাইকেল চাকমা আর জীবিত নেই ধরে নিয়ে রীতি মেনে তার শেষকৃত্যও করেছে পরিবার।
বিবিসিকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে গোপন বন্দীশালায় কাটানো দিনগুলোর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন মাইকেল চাকমা। ছেড়ে দেয়ার আগে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার রাতটিকে জীবনের অন্তিম সময় হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন তিনি।
বিবিসিকে মাইকেল চাকমা বলেন, শেষ রাতে তাকে গাড়িতে নেয়ার সময় কিছুটা আলগা করে চোখে কাপড় বাঁধা ছিল, যেটি এক পর্যায়ে গাড়ির সিটে ঘসে ঘসে কিছুটা নামাতে সক্ষম হন। এবং আজানের পর কিছুটা আলোর দেখা পান।
২০১৯ সালের পর ৬ আগস্ট ২০২৪ সালে প্রথম দিনের আলোর দেখা পান মাইকেল চাকমা। তবে তাকে যে এদিন ছেড়ে দেয়া হবে সেটি কল্পনাও করেননি।
‘ভাবছিলাম যে আমাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে আজকে রাতে মেরে ফেলবে।’
দীর্ঘদিন পর ফিরে এসে মাইকেল চাকমা বলছেন, তার জীবনের এই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর যারা শেষ করে দিয়েছে তাদের বিচার করতে হবে। এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী এর সাথে জড়িত ছিল বলেই তার অভিযোগ।
কিছুটা সুস্থ্ ও স্বাভাবিক হলে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন বলেও বিবিসিকে জানিয়েছেন মাইকেল চাকমা।
এতদিন কোথায় রাখা হয়?
মাইকেল চাকমা জানান, গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বেশ কয়েকটি গোপন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছে। শুরুর দিকে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। তবে মাইকেল চাকমা জানিয়েছেন তাকে কোনো মারপিট করা হয়নি। তবে যেভাবে একাকী বন্দি করে রাখা হয় এবং যে পরিবেশে রাখা হয় সেটি তার ভাষায় অত্যন্ত অমানবিক এবং ভয়ঙ্কর রকমের মানসিক অত্যাচার।
‘যেভাবে তারা রাখে এটাতো অত্যন্ত অমানবিক। এটাতো মানুষের বসবাসের জায়গা না। মানুষ এভাবে বাঁচে না। এটাতো কবরের মতো। গুহা আছে না গুহা, গুহায় থাকলে মানুষ যেভাবে কিছুই দেখে না, কবরে থাকলে মানুষ যে কিছুই দেখে না ঠিক এই রকম।’
‘এটাতো মানুষের বাঁচার মতো কোনো জায়গা না। কোনো জানলা নাই, একদম কোনো আলো ঢোকে না, বাতাস ঢোকে না শুধু চারিদিকে দেয়াল,’ বলেন মাইকেল চাকমা।
মাইকেল চাকমা যেসব নির্জন ঘরে বন্দি ছিলেন সেগুলোর বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘কোনো কোনো রুম সাত ফিট বাই ১১ ফিট, কোনো রুম ছিল আট ফিট বাই ১১ বা বারো ফিট এরকমের। মানে একদম ছোট ছোট রুম। ওখানে একটা খাট আছে তিন ফিট বাই সাত ফিটের লোহার। কোনো জায়গায় কাঠের।’
মাইকেল যে বন্দিদের দেখেছেন
মাইকেল চাকমা জানান, এই দীর্ঘ সময়ে ঘুরেফিরে ৪-৫টি বন্দিশালায় তাকে রাখা হয়। এসব বন্দিশালায় আরো মানুষ আটক ছিলেন বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ে তার সাথে রাখা হয়েছে আরো দু’জনকে। এছাড়া অদেখা দু’জনের নাম তিনি শুনতে পেয়েছেন। তবে এইসব বন্দির ভাগ্যে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই মাইকেল চাকমার।
তিনি বলেন, গোপন কারাগারে কেউ কাউকে দেখার বা কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে গোসল করতে নেয়ার সময় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে তিনি কিছু বন্দি বিভিন্ন সময় দেখেছেন।
‘বিভিন্ন বয়সের লোক। কারোর আমি দেখেছি চুল পাঁকা, দাড়ি পাঁকা। কেউ কম বয়সী। কোনো কোনো লোককে দেখেছিলাম তার বয়স হয়তো পঞ্চাশ-পঁয়তাল্লিশ এরকম হবে। কোনো কোনো লোক দেখেছি ষাটের ওপরে হবে। কেউ একদম ইয়াং।’
মাইকেল চাকমার সাথে দুই দফায় দু’জন বন্দিকে একসাথে রাখা হয়েছিল। অত্যন্ত গোপনে কথা বলে তাদের পরিচয় জানতে পারেন মাইকেল। এছাড়া আরো একজনের নাম শুনতে পারেন, যিনি পাশের রুমে বন্দি ছিলেন। একসাথে যাদের সাথে ছিলেন তার মধ্যে একজনের নাম সাইদুল আরেকজন এরশাদ।
‘সাইদুলের বাড়ি ছিল রংপুরে। এরশাদের বাড়ি ছিল ঢাকার কচুক্ষেতের কাছাকাছি সে বলেছে। সাইদুলকে যেদিন নিয়ে যায়, আমি আমার বোনের নম্বর মুখস্ত করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম মোবাইল নম্বরের শেষের একটি ডিজিট আমি ভুল দিয়েছিলাম।’
মাইকেল জানান, তার পাশের সেলে জাকির নামে একজন ছিলেন বলে তিনি শুনতে পেরেছেন। রুমে আটক বন্দির আরেকজনের সাথে কথোপকথন শুনে তাদের কোনো বাহিনীর সদস্য বলে মনে হয়েছে।
‘ফিস ফিস করে বলতো আমি জাকির, আমি জাকির। আমার কাছে বার বার জানতে চেয়েছে শরিফকে তুমি চেনো কি না। তিনি বলেছিল, অপরজনের নাম শুনিনি। তাকে স্যার ডাকতো জাকির। জাকির তাকে বলেছে আমাদের সম্ভবত কোর্ট মার্শাল হবে।’
‘জাকিরকে একবার পিটিয়েছে। মারধর করেছে। জাকির ওখান থেকে এসে বলছে আমাকে অনেক আজকে মারধর করেছে। ওহ পারছি না। আমার জ্বর উঠেছে। মানে তারা কথাবার্তা বলতো। তাকে ওষুধ দিত আমি শুনতাম। এটুকু আমি শুনেছি তাদের কথা।’
সরকার পতনের পর গোপন বন্দীশালা কথিত ‘আয়না ঘর’ থেকে আরো মুক্তি পেয়েছেন ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আজমি।
কিন্তু নিখোঁজ আরো অনেকের এখনো কোনো হদিস মিলছে না। সামাজিক মাধ্যমে নানা পোস্ট এবং প্রকাশিত গোপন নথি দেখে ভেঙে পড়েছে অনেক পরিবার।
নিখোঁজ ব্যক্তিরা কারো সন্তান, কারো ভাই ও কারো স্বামী, কারো বাবা।
তাদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে পরিবারগুলো। এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব মানুষের সন্ধান বের করার দাবি তুলেছেন গুমের শিকার পরিবারগুলোর স্বজনরা।
সরকার পতনের পর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর ডিজিএফআই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে নিঁখোজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থা অফিস, সিটিটিসি কার্যালয়ের ভেতরে বন্দীশালার ঢুকে নিঁখোজ ভাই এবং অন্যান্যদের সন্ধান করেন মায়ের ডাক সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম। গুমের শিকার পরিবারদের সাথে করে ঘুরছেন আদালত থেকে অন্তবর্তী সরকার প্রধান পর্যন্ত গিয়েছেন সানজিদা।
তিনি বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সাথে কী ঘটেছে এবং কারা এর সাথে জড়িত সেগুলো খুঁজে বের করার দাবি তারা করেছেন।
তিনি জানান, গত ১৫ বছরে কমপক্ষে ছয় শতাধিক গুমের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অনেকের মৃত্যুর খবর এসেছে, কেউ কেউ ফিরে এসেছে আর এখনো অনেকে নিঁখোজ রয়েছেন।
‘ঢাকার বাইরে যে পরিবারগুলো এরা তো অপেক্ষা করে আছে। সংখ্যাটা দেড় শ’ বা দুই শ’ না। আমার মনে হয় সংখ্যাটা আরো বেশি। আপনি আবার ছাত্র আন্দোলন পর্যন্ত আসেন যদি আরো অনেক মানুষ গুম। এইটা আসলে মোস্ট প্রায়োরিটি থাকা উচিত এই যে উপদেষ্টা পরিষদ এসেছেন তাদের কাছে,’ বলেন সানজিদা।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি কমিশন গঠন করে দ্রুত পরিবারগুলোকে স্বজনদের হদিস জানানো দরকার। নূর খান লিটন দীর্ঘদিন ধরে এসব গুমের ঘটনা নিয়ে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর অনেকে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। অনেকে আছেন যে ব্যাংকে টাকা তুলতে পারছেন না। অনেকে আছেন সম্পত্তির ভাগ নিতে পারছেন না। নানান রকম জটিলতা হচ্ছে।
‘সুতরাং আমি মনে করি, পরিবারকে এখনই স্পষ্টভাবে একটা কমিশন গঠন করে তদন্ত করে কী ঘটেছে, তারা কোথায় আছে বা নেই এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা দরকার।’
গুমের সাথে জড়িতদের বিষয়ে নূর খান বলেন, ‘দুস্কৃতিকারীদের আইনের আওতায় আনা। কারণ তারা যত বড় অফিসারিই হোক, দুস্কৃতিকারী। তবে আমরা প্রতিশোধ চাই না, আমরা ন্যায্য বিচারটা চাই।’
‘আগে যে অবস্থা ছিল যে, যে কাউকে ধরে মেরে ফেলতো, বন্দি করে ফেলতো। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নখ উঠায় দিত এটা করতো, ওটা করতো, নানা নির্যাতন করতো, আমরা চাই না তেমন ঘটনা ঘটুক। আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্ত হোক। কী ঘটেছিল সেই ঘটনাগুলো প্রকাশিত হোক।’
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রি.জে (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন (এ সাক্ষাৎকার যখন নেয়া হয়েছিল তখন তিনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছিলেন। পরে তার দফতর বদল হয়) বিবিসিকে জানান, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছে।
‘কে করেছে, কীভাবে করেছে, কখন করেছে এটাতো একটা বড় ধরনের ইনভেস্টিগেশন। আমার মনে হয় পরবর্তী কেবিনেটে নিশ্চয়ই এটা উঠবে। আলাপ করে একটা কমিশন করে সেই কমিশন খুঁজে বের করবে এটা।’
নিঁখোজ ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি কিছুটা ধৈর্য্য ধারণের আহ্বান করেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা