বরিশালে পুলিশের নির্যাতনে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ২২:৩১
বরিশালে গোয়েন্দা পুলিশের নির্যাতনে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করছে তার পরিবার। ছয় দিন আগে রেজাউল করিম রেজা নামে ওই যুবককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেও কোথায় নেয়া হয়েছে এ সম্পর্কে পরিবারকে আর কিছু জানানো হয়নি। পরে হাসপাতাল থেকে কারা কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় পায় স্বজনরা। রোববার সকালে তার মৃত্যু হয়।
তবে পুলিশ বলছে, তাদের হেফাজতে থাকার সময় নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি, তবে ঘটনা তদন্ত করে দেখতে তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
পুলিশের নির্যাতনে সিলেটে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনার দুই মাসের মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে আবার এরকম একটি অভিযোগ উঠলো।
পুলিশের নির্যাতনের মৃত্যুর এই অভিযোগ উঠলো এমন দিনে, যেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বক্তব্যে জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার আর আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার জন্য পুলিশের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন।
মৃত্যুর বিষয়ে কী জানা যাচ্ছে?
৩০ বছর বয়সী রেজাউল করিম রেজা কিছু দিন আগে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে বরিশালের আদালতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। গত মঙ্গলবার রাতে বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় বরিশালের গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবির কয়েকজন সদস্য।
এরপর কয়েক দিন কোনো খোঁজখবর না থাকার পর গতকাল কারা কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে দেখতে পান। আজ ভোরে তার মৃত্যু হয়েছে।
তার পরিবারের একজন সদস্য মাসুম বিল্লাহ বলছিলেন, পুলিশের নির্যাতনে গুরুতর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।
মাসুম বিল্লাহ জানান, ‘তারা একটা নাটক করে তাকে নিয়ে গেছে। তাকে বলেছিল, বছর শেষ বা শুরু হচ্ছে, আমাকে যদি দুইজন আসামি ধরে দিতে পার, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেবো। তিনি বলেন, আমি কাকে ধরে দেবো? আমার তো এমন কোনো শত্রু নেই। আমি কাউকে ধরে দিতে পারবো না। তখন তারা বছে, কীভাবে কী করতে হয়, সেটা আমি জানি। তোমাকে আগে নিয়ে যাই, তারপর দেখাচ্ছি, কীভাবে কী করতে হয়।’
‘এরপর গাড়িতে করে নিয়ে চলে গেছে। ওই সময় ওর বাবা পুলিশের পায়েও ধরেছিল ছেড়ে দেয়ার জন্য, কিন্তু ছাড়ে নি।’
‘নিয়ে যাওয়ার পরে আর কোনো যোগাযোগ করতে দেয়নি। কোথায় নিয়ে গেছে, সেটাও জানা যায়নি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও যোগাযোগ করতে দেয়নি। গতকাল কারাগার থেকে আমাদের ফোন দিয়ে বলে তিনি হাসপাতালে আছেন। আমরা গিয়ে দেখতে পাই, তিনি অসুস্থ, রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ওই সময়েও আমাদের শুধু ওষুধ কিনে দিতে বলেছে, দেখতে বা কথা বলতে দেয়নি’ তিনি বলেন।
তার এই মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ করেছে এলাকার মানুষজন।
অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কী বলছে?
পরিবারের এই অভিযোগ মানতে রাজি নয় বরিশালের পুলিশ। তারা বলছে, এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এর আগেও মাদকের মামলার অভিযোগ ছিল এবং এবারো মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে তাকে গ্রেফতারের কয়েক দিন পরে, কারাগারে থাকার সময়।
তবে কারাগারের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কারাগারে আনার সময়েই তার শরীরে ক্ষত ছিল।
বরিশাল পুলিশের কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, তারপরেও অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তারা একটি কমিটি গঠন করেছেন।
শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ওই ব্যক্তিকে মাদকসহ পুলিশ ধরেছিল ২৯ ডিসেম্বর রাতে। পর দিন তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারাগারে থাকার সময়েই ১ তারিখে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য বাইরের হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু এই পুরো সময়ে কিন্তু পরিবার বা অন্য কারো থেকে কোনো অভিযোগ আসেনি।
তিনি জানান, ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এর আগেও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে।
‘আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখলাম যে, পুলিশের কাছে যতটুকু সময় ছিল, গ্রেফতার করে যথারীতি কোর্টে পাঠানো হয়েছে, ওই সময়ে এমন কোনো তথ্য নেই যে পুলিশ তাকে নির্যাতন করেছে। কোনো আসামির ওপর অমানবিক বা আইনবর্হিভূত কোনো কিছু না করার ব্যাপারেও আমাদের কড়া নির্দেশনা আছে। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এবং আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি যে, তিনি কার্ডিওরেসপিরেটরি ফেইলিওর হয়ে মারা গেছেন। তারপরেও পোস্টমর্টেমে বিস্তারিত জানা যাবে’ বলেনন তিনি।
পরিবারের অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, অনেক সময় যখন কেউ মারা যায়, তাদের স্বজনরা হয়তো অনুমান করে বা নানাভাবে অভিযোগগুলো আনে, এখানেও সেভাবে আনতে পারেন। আবার অনেকে তো ভুল করে বলেছে, এটা পুলিশ হেফাজতে। আসলে তিনি তো জেলখানায় ছিলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তারপরেও যতটুকু আমরা শুনেছি, যেহেতু পরিবারের সদস্যরা কেউ কেউ এরকম বলেছেন, সেটা আমরা অনুসন্ধান করে দেখবো। যদি আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নেবো’ বলেন বরিশালের পুলিশ কমিশনার।
কেন বন্ধ হচ্ছে না পুলিশের নির্যাতনের অভিযোগ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সকালে সহকারী পুলিশ সুপারদের একটি প্রশিক্ষণ সমাপনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেয়ার সময় বলেন, আমি আশা করব পুলিশ বাহিনী পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। আমরা গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষের জীবনের শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।
তিনি অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে কাজ করে যাওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশী হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ এবারই প্রথম নয়।
বিভিন্ন সময় সরকার ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ ধরণের নির্যাতন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কখনোই সেটা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
গত অক্টোবরে সিলেটে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে, যে ঘটনায় পুলিশের কয়েক সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়।
পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ বারবার কেন ওঠে? জিজ্ঞেস করেছিলাম মানবাধিকার কর্মী শীপা হাফিজার কাছে।
শীপা হাফিজা বলেন, ‘এই ঘটনা সত্যিকার অর্থেই একটা শঙ্কা তৈরি করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি হলে এটা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব। যেমন সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর কিন্তু বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড আর ঘটেনি। সুতরাং চাইলেই এটা সম্ভব। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রকে এটা খুব করে খতিয়ে দেখা উচিত এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা করা উচিত।’
নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বরিশালের মেট্রোপলিটন পুলিশ।
আর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর তারা বিচারের জন্য পরের পদক্ষেপ নেবেন।
সূত্র : বিবিসি