১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দুর্বার যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে সুপার এইটে ভারত

দুর্বার যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে সুপার এইটে ভারত - ছবি : সংগৃহীত

এই ম্যাচের গল্পটা শুরু হোক বাঁহাতি পেসার সৌরভ নেত্রভালকারকে দিয়েই।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ বছর বয়সী পেসার স্বপ্নের মতো বিশ্বকাপ কাটাচ্ছেন। আগের ম্যাচে সুপার ওভারে পাকিস্তানকে হারানোর নায়ক ছিলেন, এ দিনও বল হাতে শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু সেই নেত্রভালকারই শেষ পর্যন্ত বলতে পারেন, হয়তো তার হাত গলেই বেরিয়ে গেল ম্যাচ।

বুধবার ১১১ রান তাড়া করার পথে তনোও ৪৫ বলে ৫৩ রান দরকার ছিল ভারতের। নাসাউ কাউন্টির মাঠে একেকটা রান তোলা যেন কঠিন একেকটা হার্ডল। সূর্যকুমার যাদব করে ফেলেছিলেন ২২, তার ওপরেই অনেকটা নির্ভর করছিল ভারতের আশা। ভ্যান শ্যালকাইকের বলটা আকাশে তুলে দিলেন সূর্যকুমার, কিন্তু থার্ডম্যানে দৌড়ে গিয়ে বলটা হাতে নিয়েও রাখতে পারলেন না নেত্রভালকার। এই সূর্যকুমার ছিলেন নেত্রভালকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মুম্বাইতে অনূর্ধ্ব ১৫ দলে দুজন খেলেছেন একসঙ্গে।ম্যাচ শেষে সূর্যকুমার হয়ত তাকে ধন্যবাদ জানাবেন। ‘কর্মভূমিকে' ডোবালেও জন্মভূমির তো ‘উপকারই' করেছেন নেত্রভালকার!

এই কর্মভূ্মি আর জন্মভূমির ব্যাপারটা সৌরভ নেত্রভালকারই বলেছেন ম্যাচের আগে। ভারতে জন্ম তার- বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটের হাতেখড়ি, বয়সভিত্তিক দলে খেলা সবই সেখানে। এরপর কম্পিউটার প্রকৌশলী নেত্রভালকার ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে, কাজ নেন স্বনামধন্য এক প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ক্রিকেট ছাড়েনি তাকে, যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে আজ জন্মভূমি ভারতকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বাঁ হাতি পেসার।

তার মতো ‘পার্টটাইম‘ ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্র, যারা বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে হারানোর পর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকেও হারিয়ে দেয়, তাদের জন্য ভারতকে শুধু কাঁপিয়ে দেওয়াটা বোধ হয় যথেষ্ট নয়। মাঠে অবশ্য অভিবাদন তারা পেয়েছে বিস্তর। কাগজে-কলমে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগতিক, কিন্তু মাঠ তো তেরঙ্গা পতাকার দখলে। ভারতীয়-অ্যামেরিকানরাই মাতিয়ে রাখেন নাসাউ কাউন্টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্যালারি। তবে ভারতের উইকেট আর রানে তারা যেমন উল্লাস করেছেন, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের উইকেট ও রানও উদযাপন করেছেন।

ম্যাচের আগেই যুক্তরাষ্ট্র বড় এক ধাক্কা খায়! চোটের জন্য এই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েন নিয়মিত অধিনায়ক ও পাকিস্তানের ম্যাচের সেরা ব্যাটার মোনাংক প্যাটেল। টস করতে হয় অ্যারন জোন্সকে। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই ধাক্কা খায় তারা, শায়ান জাহাঙ্গীরকে ফিরিয়ে দেন আর্শদীপ সিং। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ম্যাচের প্রথম বলেই উইকেট পাওয়ার কীর্তি খুব বেশি নেই। ২০১৪-র আসরে প্রথমে যিনি তা করেছিলেন তার নামটা আপনার চেনা- মাশরাফি বিন মুর্তজা৷ আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিলেন তিনি।

আর্শদীপ পুরো সময়েই ভুগিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। বিস্ময়করভাবে জাসপ্রিত বুমরাহ আজ সেরকম বিধ্বংসী ছিলেন না। আর্শদীপ একাই প্রায় একশ' ছিলেন৷ শায়ান জাহাঙ্গীরকে প্রথম বলে ফেরানোর পর প্রথম ওভারেই আন্দ্রিয়েস গউসকেও ফিরিয়ে টালমাটাল করে দেন যুক্তরাষ্ট্রকে। এরপর অধিনায়ক জোন্স ও স্টিভেন টেলর ইনিংস মেরামতের কাজ শুরু করেন। রান খুব একটা না এলেও উইকেট পড়তে দিচ্ছিলেন না তারা।

জোন্সকে আউট করে হার্দিক পান্ডিয়া ভাঙেন জুটি। টেলর দুই ছয়ে যখন বড় কিছুর আভাস দিচ্ছিলেন, তখনই ২৪ রানে বোল্ড হয়ে যান আক্সার প্যাটেলের বলে।৫৬ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর ক্রিজে আসেন নিতিশ কুমার, যুক্তরাষ্ট্রের রানের চাকাটা এরপরেই দ্রুত ঘুরতে শুরু করে। ২৩ বলে ২৭ রান করে নিতিশ যুক্তরাষ্ট্রকে ১২০ এর কাছাকাছি কিছুর স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু আর্শদীপ এবারও হন্তারক, তার বলে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন সিরাজ।

এরপর কোরি অ্যান্ডারসন, হারমিত সিং, ভ্যান শ্যালকাইকে চেষ্টা করেছিলেন শেষ দিকে। শেষ ৫ ওভারে ২৯ রান তোলে যুক্তরাষ্ট্র। তবে শেষদিকে ভারতের বোলাররা রানটা বেশি বাড়তে দেননি। ৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তার মূল কৃতিত্ব অবশ্যই ম্যাচসেরা আর্শদীপের।

তবে ১১০ রানের পুঁজি নিয়েই স্বাগতিকদের শুরু হলো স্বপ্নের মতো। বিরাট কোহলিকে মুখোমুখি প্রথম বলেই স্টাম্পের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন নেত্রভালকার৷ টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে মাত্র দ্বিতীয় ‘গোল্ডেন ডাক' কোহলির। নেত্রভালকারের পরের ওভারে যখন অধিনায়ক রোহিত শর্মাও ফ্লিক করতে গিয়ে মিড অফে ক্যাচ তুলে দেন, তখন স্কোর বোর্ডে ভারতের রান মাত্র ১০!

১০ রানে ২ উইকেট হারানো ভারতের বিপদ আরো বড় হলো ভালো খেলতে থাকা ঋশভ পান্ত আলী খানের নিচু হয়ে আসা বলে বোল্ড হয়ে গেলে। পান্তের রান তখন ১৮, ভারতের ৩৯৷ সূর্যকুমারের ওপর তখন অনেকটাই আশা। নিরাশ করেননি তিনি, জ্বলে উঠেছেন সূর্যের মতোই। ওপাশে শিবম দুবে একেবারেই নড়বড়ে ছিলেন৷ সূর্যকুমার ঠিক করলেন উইকেট হারাতে দেবেন না। ২২ রানে ওই জীবন পাওয়ার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সাতের ওপর চলে যাওয়া রান রেট আর বাড়তে দেননি। এর মধ্যে তিনবার ওভার শুরু করতে এক মিনিটের বেশি সময় নেয়ায় ৫ রান পেনাল্টি দিয়ে যুক্তরাষ্টের ফিল্ডাররাও কাজ আরো সহজ করে দেন। ম্যাচ নিয়ে যতটুকু অনিশ্চয়তা ছিল ১৭তম ওভারে টানা দুই বলে ছয়-চার মেরে তা-ও শেষ করে দেন সূর্যকুমার যাদব।৪৯ বলে করেছেন ফিফটি, নিজের স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সাথে যা আশ্চর্যরকমের ব্যতিক্রম।

নিউইয়র্ক নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের ড্রপ-ইন পিচে লো স্কোরিং থ্রিলারের গল্প এখানেই শেষ। বিশ্বকাপে নিউ ইয়র্কের শেষ ম্যাচটা হয়ে গেল এখানে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট ইতিহাসে এই মাঠের নাম অনেক দিন লেখা থাকবে। রেকর্ডবুক বলবে, এখানেই পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছিল মার্কিনিরা। তবে ভারতকে কাঁপিয়েও শেষ পর্যন্ত পারেনি। আর হয়তো ইতিহাস বলবে- এই মাঠ দিয়েই ক্রিকেটে নতুন দিনের গান শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

সংক্ষিপ্ত স্কোর :

যুক্তরাষ্ট্র : ২০ ওভারে ১১০-৮ (নিতিশ ২৭, টেলর ২৪; আর্শদীপ ৪-৯, পান্ডিয়া ২-১৪)

ভারত : ১৮.২ ওভারে ১১১-৩ (সূর্যকুমার ৫০*, দুবে ৩১*; নেত্রভালকার ২-১৮, আলী খান ১-২১)

ফল: ভারত ৭ উইকেটে জয়ী


আরো সংবাদ



premium cement