দ্বিস্তর টেস্টের পক্ষে-বিপক্ষে যা বলছে ক্রিকেট বিশ্ব
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:৩৪
দ্বিস্তর টেস্ট ক্রিকেট ব্যবস্থা- এমন এক ব্যবস্থা যেখানে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা হবে। প্রাথমিক আলোচনা অনুযায়ী প্রথম ভাগে সাতটি দল থাকবে, দ্বিতীয় ভাগে থাকবে পাঁচটি দল।
চলতি মাসের শেষ দিকে দ্বিস্তর টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে একটা আলোচনায় বসবে ক্রিকেট বিশ্বের শীর্ষ তিন বোর্ড, যারা ‘ক্রিকেটের মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত। যেখানে ঠিক হতে পারে টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কেমন হতে চলেছে? কোন ক্রিকেট দল কোন দলের বিপক্ষে মাঠে নামবে? অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মেলবোর্ন এজ এমনটাই বলছে।
টেস্ট ক্রিকেটের সম্ভাব্য এই নতুন নীতিকে ‘দ্বিস্তর’ বলা হচ্ছে, যেখানে দলগুলোকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হবে। ১২টি দেশ এখন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই ফরম্যাটে খেলে, তাদের মধ্যেই ‘বড় দল ও ছোট দলে’ ভাগ করে খেলা হবে বলে আলোচনা চলছে।
টেস্ট ক্রিকেটের এই নতুন ধারা কেমন হতে পারে?
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের বর্তমান প্রধান জয় শাহ ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান মাইক বেয়ার্ড ও ইংলিশ ক্রিকেটের প্রধান রিচার্ড থম্পসনের সাথে বসতে যাচ্ছেন।
এই সভায় বিশ্ব ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপের ভবিষ্যৎ আলোচনা হবে।
এখানেই দ্বিস্তর টেস্ট ক্রিকেট ব্যবস্থা নিয়ে কথা হবে বলে বলছে মেলবোর্ন এজ পত্রিকা।
এই প্রস্তাবনায় আছে প্রথম স্তরে থাকবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ড।
দ্বিতীয় স্তরে থাকবে বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে।
চলমান টেস্ট ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ ও আসন্ন চ্যাম্পিয়নশিপের সূচি এরই মধ্যে চূড়ান্ত হওয়ায় দ্বিস্তর টেস্ট ক্রিকেট চালু হতে পারে ২০২৭ সাল থেকে।
‘টেস্ট ক্রিকেট বাঁচাতে’ প্রয়োজন দ্বিস্তর কাঠামো
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টেস্ট ক্রিকেট সিরিজ বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি, যেখানে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত মুখোমুখি হয়েছিল। এবারের সিরিজ ৩-১ ব্যবধানে জিতে ১০ বছর পর এই ট্রফি পুনরুদ্ধার করেছে প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া।
মাঠের ক্রিকেটের উত্তেজনায় রং চড়িয়েছে গ্যালারি-ভর্তি দর্শক, এবারের বর্ডার গাভাস্কার ট্রফির পাঁচ ম্যাচে মোট আট লাখ ৩৭ হাজারের বেশি দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখেছে।
ক্রিকেট বিশ্বের জনপ্রিয় সব মাঠ মেলবোর্ড, সিডনি, পার্থ ভরে উঠেছে ভিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাদের বিপক্ষে প্যাট কামিন্স স্টিভ স্মিথদের লড়াই দেখতে।
২০১৮-১৯ মৌসুম থেকে বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির সম্প্রচারের কাজ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার দুই বিখ্যাত ব্রডকাস্টার সেভেন ও ফক্স স্পোর্টস। কর্তৃপক্ষ বলছে, এবার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ভিউয়ারশিপ পেয়েছে।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে পোস্ট হওয়া ভিডিওগুলো দুই বিলিয়নের বেশিবার দেখেছে দর্শকরা।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বলছে, অ্যাশেজ ছাড়া কোনো সিরিজেই এমন দর্শক পাওয়া যায় না।
অ্যাশেজ খেলে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড, এটাই টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাচীন ও অভিজাত লড়াই।
দর্শকের সংখ্যা ও মানুষের আগ্রহ দেখে সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকেই বলছেন, টেস্ট ক্রিকেট টিকিয়ে রাখতে এই ধরনের সিরিজ বেশি হওয়া প্রয়োজন আর এখানেই আসছে দ্বিস্তর কাঠামোর আলোচনা।
বিশ্লেষক ও সাবেক ক্রিকেটারদের কেউ কেউ বলছেন, টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতেই প্রয়োজন দ্বিস্তর নীতি।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফে নিজের কলামে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন লিখেছেন, ‘আমি অনেক আগে থেকেই বলে আসছি টেস্ট ক্রিকেটকে প্রাসঙ্গিক রাখতে সেরা দলগুলোকে যত বেশি খেলানো যায় তত ভালো।’
এখানে ভন ছোট দলের সাথে বড় দলের খেলাগুলোকে ‘অসম লড়াই’ আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘মাঠে হোক আর টেলিভিশনে- সমর্থকরা যা দেখতে চায় সেটাই দিতে চাই আমি।’
মাইকেল ভন ওপরে উল্লেখ করা বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির পরিসংখ্যানেই জোর দিয়ে দেখিয়েছেন, ‘দেখুন গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়ায় কী হয়, দেখুন গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে কী হয়, দর্শকরা এটাই দেখতে চায়।’
বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির অন্যতম ধারাভাষ্যকার এবং ভারতের হয়ে বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ক্রিকেটার রাভি শাস্ত্রীও দ্বিস্তর টেস্ট ক্রিকেট কাঠামোর পক্ষেই রায় দিয়েছেন।
রাভি শাস্ত্রীর মতে, পাঁচ দিনের ক্রিকেটের টিকে থাকার জন্য বড় দলগুলোর একের বিপক্ষে বেশি খেলাটা জরুরি।
অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্য অস্ট্রেলিয়ানে তিনি মত দিয়েছেন, ‘যখন সেরা দলগুলো খেলে, ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন এবং সেরা ফরম্যাট প্রানবন্ত ও সমৃদ্ধ হয়।’
তিনি আইসিসিকে এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবনার তাগিদ দিয়েছেন, ‘দেখেন না হলে খেলাটা অনেক বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। শীর্ষ ছয়টি বা আটটি দল যদি থাকে সেখানে প্রমোশন পাওয়া বা নিচের স্তরে নেমে আসার বিষয় থাকবে, যদি দু’টি সমমানের দল খেলে সেখানে এই রকম (ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের মতো) দর্শক পাবেন।’
দ্বিস্তর কাঠামো হতে পারে ‘টেস্ট ক্রিকেটের অপমৃত্যু’
দ্বি-স্তর টেস্ট ক্রিকেট কাঠামোর বিপক্ষেও আছেন অনেকেই। যেমন দ্য টেলিগ্রাফের খ্যাতনামা ক্রিকেট লেখক স্কাইল্ড ব্যারি মনে করেন, ‘দ্বিস্তর কাঠামো টেস্ট ক্রিকেটের অপমৃত্যু ডেকে আনতে পারে। দেখুন বিগ থ্রি (অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ভারত) কিন্তু নিয়মিত একে ওপরের বিপক্ষে খেলছে না, এখন যদি তাদের অতি নিয়মিত খেলান এতে সিরিজের এমন আমেজ থাকবে না।’
তিনি যোগ করেন, ‘ইতোমধ্যে অ্যাশেজ সিরিজ অনেক সংকীর্ণ সূচির মধ্যে খেলা হয়, যদি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে দু’বছরের চক্রে একটা অ্যাশেজ হয় সেটা হবে ইংল্যান্ডে অথবা অস্ট্রেলিয়ায়, কোনোভাবেই দু’টি অ্যাশেজ এক চক্রে আনার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। এটা টেস্ট ক্রিকেটকে দ্রুত মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে।’
সাবেক উইকেটকিপার ড্যারেন বেরি অস্ট্রেলিয়ান ক্রীড়া সংবাদমাধ্যম স্পোর্টস এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্ক এসইএন ব্রেকফাস্ট পডকাস্টে বলেছেন, বড় দলগুলোকে খেলানোর ওপর আইসিসি নির্ভর করলে এটা হবে সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে ফেলার মতোই এক ভাবনা।
তিনি আরেকটা শংকার কথাও তুলে এনেছেন, ‘ধরে নেই সেরা ছয় দল, আর তুলনামূলক কম ভালো খেলা ছয় দলে আলাদা করলাম, কথার খাতিরে বলছি যদি কখনো ভারত বা অস্ট্রেলিয়া নিচের সারিতে চলে আসে তখন কী হবে? তখন যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে সেটা তো অনেক বড়।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সদ্য সাবেক হওয়া প্রধান গ্রেগ বার্কলে কিছুদিন আগে প্রশ্ন তুলেছিলেন জিম্বাবুয়ে বা আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলো কি টেস্ট ক্রিকেট থেকে আসলেই লাভবান হচ্ছে নাকি শুধু স্ট্যাটাস পেয়েছে বলেই খেলতে চাচ্ছে?
তিনি জানান, জিম্বাবুয়ে টেস্ট সিরিজ আয়োজন করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
দ্বিস্তর টেস্ট ক্রিকেট কাঠামো নিয়ে ভাবনা কিন্তু নতুন কিছু নয়, ২০১৬ সালেই এটা আলোচনায় উঠে এসেছিল। তখন ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিসিআই এই কাঠামোর বিরোধিতা করায় বাস্তবায়ন হয়নি।
এবার ভারতের ক্রিকেটের সাবেক প্রধান জয় শাহ আইসিসির প্রধান হিসেবে কাজ করছেন, জানুয়ারির শেষ দিকের আলোচনায় কী সিদ্ধান্ত আসে সেদিকে চোখ থাকবে ক্রিকেট বিশ্বের।
মমিনুল হকের মতে, দ্বিস্তর ক্রিকেট কাঠামোর ভাবনা ‘হতাশাজনক’
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের পরিচিত মুখ মমিনুল হক ক্রিকেট পোর্টাল ক্রিকবাজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি কোনো দলকে ছোট বা বড় করে দেখতে চাই না। আমি জানি না কিভাবে এটা নির্ধারণ হবে। আমি এটা নিশ্চিত না যে আমরা দ্বিতীয় স্তরে ভালো খেলেও প্রথম স্তরে উঠতে পারব কি না।’
টেস্ট ক্রিকেটে ১৩টি সেঞ্চুরি ও প্রায় সাড়ে চার হাজার রানের মালিক মমিনুল আশঙ্কা করছেন, এই কাঠামোর বাস্তবায়ন হলে টেস্ট ক্রিকেট খেলা আরো কমে আসবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বড় দলের বিপক্ষে না খেলি তাহলে তো আমাদের ক্রিকেটে উন্নতি আসবে না।’
বাংলাদেশ শেষবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলেছে ২০১৬ সালে, শেষবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই ম্যাচের একটি টেস্ট সিরিজ খেলেছে ২০১৭ সালে।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাংলাদেশ গত ২২ বছরে কোনো টেস্ট খেলার সুযোগ পায়নি, ইংল্যান্ডের মাটিতে খেলেছিল শেষ ২০১০ সালে।
বর্তমানে টেস্ট ক্রিকেটের সেরা ব্যাটারদের একজন জো রুট ২০২০ থেকে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ৬২টি টেস্ট খেলেছেন চার বছরে।
মমিনুল হকের অভিষেক হয়েছিল ২০১৩ সালে, গত ১১ বছরে মমিনুল হক খেলেছেন ৬৯টি টেস্ট ম্যাচ।
গত আট বছরে বাংলাদেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ জিতেছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের দেশে গিয়ে টেস্ট জিতে এসেছে। পাকিস্তানকে তাদের ঘরের মাঠে হোয়াইটওয়াশ করেছে ২০২৪ সালেই।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা