যেভাবে ‘হারিয়ে’ গিয়েছিলেন সাঈদ আনোয়ার
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:১৭
তেহরান টালমাটাল হতে শুরু করেছে তখন। ইসলামিক বিপ্লব আর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে ইরানের রাজধানী। সময়টা ১৯৭৭ সাল। স্বস্তির খোঁজে নয় বছরের সন্তান সাঈদকে তেহরান থেকে নিজের শহর পাকিস্তানে করাচি পাঠিয়ে দেন ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার আহমেদ, আর নিজে রওনা হয়ে যান সৌদি আরবের পথে।
তেহরানের রাস্তায় ফুটবল খেলে বেড়ে ওঠা সাঈদ ক্রিকেটের বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিল না। তবে শুধু সে নয়, কেউই তখন আঁচ করতে পারেনি যে ১১ বছর পর এই সাঈদ আনোয়ারই পাকিস্তানের লাহোর স্টেডিয়ামে ব্যাট হাতে কবজি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একের পর এক ছক্কা মেরে যাবেন, আর পরিণত হবেন পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ওপেনার ব্যাটসম্যানে।
ওয়ানডে ওপেনিংয়ের ধারণাই পাল্টে দিয়েছিলেন সাঈদ আনোয়ার। মাঠে নেমেই ঝড় তুলে ফেলতে পারেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছিলেন তিনি।
মাইকেল স্লেটার, রমেশ কালুয়াথারানা বা সনাথ জয়সুরিয়ার মধ্যে একই ধরনের আক্রমণাত্মক ব্যাটিং দেখা গেলেও শান্ত-সৌম্য সাঈদ আনোয়ারকে মনে করা হতো ওপেনিংয়ের সেরা। ব্যাটের আগ্রাসী আচরণ বাঁ-হাতি এই বেটারকে পরিণত করেছিল বোলারদের ‘দুঃস্বপ্নে’।
তবে খুব প্রত্যাশিতভাবে ও বলতে গেলে অনেকটা হুট করেই ক্রিকেট বিশ্ব ছেড়ে আড়ালে চলে যেতে হয়েছিল এই কিংবদন্তীকে।
যুগের সেরা
সাঈদ আনোয়ারের ওপর চোখ পড়েছিল পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেট দল ইউবিএলের কোচ হারুন রশিদের। সাঈদ তখন করাচি অ্যাসোসিয়েশনের অনুর্ধ্ব-১৯ টিমে খেলছেন।
বিবিসি উর্দুকে তিনি বলেছিলেন, ‘ছেলেটার মধ্যে একটা স্ফূলিঙ্গ দেখেছিলাম। সম্ভবত তখন ১৯৮৭ সাল। অনুর্ধ্ব ১৯-এর ফাইনালে সে যেভাবে আমাদের টিমের বিরুদ্ধে ব্যাটিং করেছে তাতে নৈপুণ্য ছিল। কাট ও মিড উইকেটে খুবই ভালো করছিল সে।’
ক্রিকেট নৈপুণ্যে সাঈদ আনোয়ারকে সমবসময়ই আরেক কিংবদন্তী ব্রায়ান লারার সমক্ষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইমরান খান। বরং সাঈদকে আরেকটু এগিয়ে রাখতেন তিনি।
ইমরান খানের ভাষ্য ছিল, ‘ওকে (সাঈদ) আমি টেন্ডুলকার ও ব্রায়ান লারার মাঝখানে রাখব। কারণ সে যুগে বলের টাইমিং তার চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝত না।’
কবজির শক্তি প্রমাণিত হয়েছিল আগেই
তেহরান থেকে পাকিস্তানে ফিরেই ছোট্ট সাঈদ ক্রিকেটে নেমে পড়ে, এমন ছিল না বিষয়টা। বরং তার প্রিয় খেলা ছিল স্কোয়াশ। আর লেখাপড়ার ফাঁকে অবসরে সে বেশিরভাগ সময় কাটাতো টেনিস খেলে।
তবে এই দু’টি খেলাই তার হাতকে ক্রিকেটের জন্য আরো বেশি উপযোগী করে তুলেছিল। যেমন খুশি তেমন করে কবজি ঘোরানোর নমনীয়তা ও শক্তি এনে দিয়েছিল।
সাবেক পাকিস্তানি বোলার সাকলায়েন মোস্তাক যেমন বলছিলেন, ‘সাঈদ ভাই প্রায়ই বলতেন যে দেখো, স্কোয়াশ আর টেবিল টেনিস খেলতে খেলতে আমার কবজি এত বলিষ্ঠ হয়েছে যে কোনো ধরনের বল খেলতেই আমার আর কষ্ট হয় না।’
‘তার দৃষ্টিশক্তিও খুব ভালো ছিল। অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে বল আকাশে ওঠার পর দেখা শুরু করতেন, সাঈদ ভাই কিন্তু বোলারের হাত থেকেই বলের ওপর নজর রাখা শুরু করতেন।’
আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন
মালির জিমখানা টিমে খেলতে শুরু করার পর আট বা নয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে নামতেন সাঈদ। করাচি ইউনিভার্সিটিতে তখন কম্পিউটার সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক পড়ছেন তিনি।
অন্যান্য বন্ধুদের মতো মাস্টার্স করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ারও স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু পরে এই পরিকল্পনা ছেড়ে ক্রিকেটেই রয়ে যান তিনি।
বোলিংয়ে ‘দুসরা’র জনক বলা হয় যাকে, সেই সাকলায়েন মুস্তাক বিবিসি উর্দুকে বলছিলেন, সাঈদ আনোয়ার খুব মনোযোগ আর দৃঢ়তার সাথে ক্রিকেটের ট্রেনিংয়ে অংশ নিতেন।
‘এটা ঠিক যে তার মেধা সৃষ্টাপ্রদত্ত। কিন্তু তিনি কঠোর পরিশ্রমও করতেন। ট্রেনিংয়ে নানা রকম চ্যালেঞ্জ নিতেন। তিনি বলতেন, ট্রেনিংয়ে সহজ খেলে কী লাভ? আমাকে তো মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’
‘ক্রিকেটের চেয়েও বেশ কিছু’
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইনজামাম-উল-হক বলেছেন, ‘আমরা রাতে ঘুমের মধ্যে যেরকম খেলার স্বপ্ন দেখতাম, সকালে উঠে দেখতাম সাঈদ আনোয়ার সেটাই খেলছেন। তার ব্যাটিং দেখে মনে হতো ক্রিকেট যেন কত সহজ! কিন্তু মাঠে নামলে বোঝা যেত কষ্টটা কতখানি।’
নৈপুণ্যের বিচার তো আছেই, পরিসংখ্যানও ক্রিকেটে অনন্য জায়গায় রেখেছে সাঈদ আনোয়ারকে। যুগের সেরা বলা হয় যে ব্রায়ান লারাকে, তার চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই তার অর্জন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কয়েকটি ওডিআই-তেই সাঈদ যে কৃতিতেব স্বাক্ষর রাখেন, তা দেখে তখনকার অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন অ্যালেন বোর্ডার বলেছিলেন, ‘নতুন এই ছেলেটা যা করছে, তা শুধু ক্রিকেট নয়, বরং অন্যকিছু।’
দ্য ওভালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৭৬ রানের ইনিংস খেলার পর ধারাভাষ্যকার ও সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জিয়োফ্রি বয়কট ‘বোলারদের দুঃস্বপ্ন’ আখ্যা দিয়েছিলেন সাঈদ আনোয়ারকে।
মাঠের বাইরে যেকোনো জায়গায় সাঈদ আনোয়ারের অনন্য ব্যক্তিত্বের কথা স্মরণ করেন তার সতীর্থরা। সাকলায়েন মোস্তাক যেমন বলছিলেন, ‘ক্রিকেট হোক, হাসি ঠাট্টা হোক, যেকোনো জমায়েতে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসতেন তিনি।’
মোস্তাক আরো বলছিলেন, ‘কোন বলটা খেলতে হবে, কোন বলটা উইকেট কিপারের হাতে চলে যেতে পারে, সেটা আমাদের বলে দেয়া হতো। কিন্তু সাঈদ ভাই সবসময়ই কমফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে খেলতেন।’
‘বল যখন বোলারের হাতে, তখনই তিনি বলতে পারতেন এটা কতটুকু নিচে নামতে পারে, কতটুকু বাঁকা হয়ে আসবে। বলের গতিবিধি আঁচ করে খেলার মতো ক্রিকেটার ছিলেন তিনি,’ যোগ করেন তিনি।
‘টপ স্পিন, অফ স্পিন, দুসরা... আমি সব ধরনের বল করতাম। সব ধরনের বলেই তিনি ভালো মারতেন। নেটে ৯৯.৯৯ শতাংশ টাইমে তিনি আগেই বলতে পারতেন বলের দৈর্ঘ্য কী রকম হবে। নিজের হাতে মেপে এটা বলতে পারতেন তিনি, যেটা আমাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল। আমি কেটে পড়তে চাইলে তিনি বাধা দিয়ে বলতেন, তুমি চলে যেতে চাইছো কেন ভাই?’
অনিল কুম্বলে, শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিথরন কারো বল খেলতেই তার সমস্যা হতো না, বলছিলেন সাকলায়েন মোস্তাক।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর মাঠে ফিরে চেন্নাইয়ে ভারতের বিপক্ষে যেদিন তিনি ১৯৪ রান করেছিলেন, সেই ম্যাচটা আজও অনেকের চোখে ভাসে। সেদিন তিনি স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের যে রেকর্ড ভেঙেছিলেন, তা পরবর্তী ১৩ বছরেও কেউ ছুঁতে পারেনি।
১৯৯০ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকে শেষ অব্দি সব ইনিংসেই তার স্ট্রাইকিং রেট ৯০ এর ওপরে ছিল।
টেস্টে তিনি কেবল ৫৫টি ম্যাট খেলেছেন। কিন্তু অন্যতম শক্তিশালী চার দল দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তার স্ট্রাইকিং রেট ৪০ যা তার মেধার প্রমাণ রাখে।
ছেড়ে যেতে হলো কেন?
বরাবরই সাঈদ আনোয়ারের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পথে অন্যতম বাধা ছিল ইনজুরি। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত কেবল পাঁচটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন তিনি।
তবে মাঠে ফিরেই পরপর তিনটি শতক হাঁকান।
১৯৯৯ সালে হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার পর এক বছরের মতো ইনজুরি নিয়েই তিনি খেলা চালিয়ে গেছেন।
আরব নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাঈদ আনোয়ার এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলার মতো বিকল্প আর কেউ ছিল না আমাদের। খেলা চালিয়ে যাওয়ার কারণে সমস্যা এতোটাই বাড়ে যে আমাকে পরের বছর সার্জারি করাতে হয়।’
সার্জারি থেকে ফেরার পর শারজায় ৬০ রানের এক ইনিংস খেলেন তিনি এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিনই আবার ইনজুরির শিকার হন।
যেভাবে সমাপ্তি
সেদিন মুলতান টেস্টে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় উদযাপনের প্রহর গুনছিল পাকিস্তান টিম, ঠিক তখনই এমন এক দুঃসংবাদ আসে, যা পরে সাঈদ আনোয়ারের ক্যায়িয়ারের গল্পটাকেই স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
অত্যন্ত কম বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সাঈদ আনোয়ারের একমাত্র মেয়ে। এই ক্রিকেটারে পুরো জীবনধারাকেই পাল্টে ফেলে এই ঘটনা। মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঠে ফিরছিলেন না তিনি। অবশেষে যখন ফিরলেন, অনেকেই আর তাকে চিনতে পারল না।
দাঁড়িতে মুখ ঢাকা সাঈদ আনোয়ারকে চিনতে না পেরে শারজাহ স্টেডিয়ামে ঢুকতে দিতে চাননি নিরাপত্তাকর্মীরা।
সেদিন অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মাঠে ঢুকতে পারলেও সমালোচকদের তীর থেকে তিনি রেহাই পাননি। মাঠে তার প্রতিটি ভুলের জন্য তার ধার্মিক জীবনযাপনকে দায়ী করছিলেন সমালোচকরা।
২০০৩ সালে অবসরের ঘোষণা জানাতে গিয়ে প্রেস কনফারেন্সে সাঈদ আনোয়ার বলেন, ‘আমি ইমরান খানের মতো করে জয়ের মালা গলায় বিদায় নিতে চেয়েছিলাম। হয়তো আমি আরো দুই বছর খেলতে পারতাম। কিন্তু বোঝানো হচ্ছে আসলে আমাকে আর দরকার নেই।’
এর আগে এক সাক্ষাৎকারে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিলেও ধারাভাষ্যে যুক্ত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন সাঈদ। কিন্তু অবসরের পর তিনি পুরোপুরি ক্রিকেট দুনিয়া ছেড়ে দেন।
২০১০ সালে প্রধান নির্বাচক ইকবাল কাশেম অবসরে চলে গেলে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড পিসিবি সাঈদ আনোয়ারকে এই কাজের প্রস্তাব দেয়। তবে খেলোয়ার বাছাই করতে গিয়ে ন্যায়বিচার করতে পারবেন না উল্লেখ করে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন সাঈদ আনোয়ার।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা