০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

বাংলাদেশের সিরিজে কেন এত নিরাপত্তা ভারতে?

বাংলাদেশের সিরিজে কেন এত নিরাপত্তা ভারতে? - সংগৃহীত

গত শতাব্দীর আশি বা নব্বইয়ের দশকে যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দল ভারতে নিয়মিত সিরিজ বা কোনো টুর্নামেন্ট খেলতে যেত, কড়া নিরাপত্তার দৃশ্য তখন হামেশাই চোখে পড়ত।

স্টেডিয়ামের বাইরে ও ভেতরে তখন গিজগিজ করত পুলিশ, মাঠে ঢোকার ক্ষেত্রে থাকত হাজারো কড়াকড়ি। বিভিন্ন উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী মাঠে গোলযোগ বাঁধানোর চেষ্টা করতে পারে, এই আশঙ্কায় তটস্থ থাকতে হতো ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের।

১৯৯১ সালে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা দলের কর্মীরা তো একবার মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচ খুঁড়ে দিয়ে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচই ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন। ‘সন্ত্রাসবাদে মদতদাতা’ পাকিস্তানের সাথে কোনো খেলা নয়- এটাই ছিল তখন শিবসেনার ঘোষিত নীতি।

সেই ঘটনার ৩৩ বছর পর আজও ভারতের কোনো মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে ম্যাচ ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা আটকাতে প্রশাসনকে বিরাট কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে, হাজারে হাজারে পুলিশ মোতায়েন হবে বা কালো পতাকা নিয়ে মাঠে ঢুকতে বাধা দিতে হবে- এ জিনিস কিন্তু প্রায় অকল্পনীয় ছিল।

অথচ গত রোববার (৬ অক্টোবর) গোয়ালিয়রে ভারত বনাম বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচটির আগে অবিকল সেই দৃশ্যই দেখা গেছে।

ওই ম্যাচের মাধ্যমেই দীর্ঘ ১৪ বছর পর শহরে ফিরেছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট- অথচ ম্যাচ যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে সে জন্য পুরো গোয়ালিয়রকে মুড়ে ফেলা হয়েছিল কড়া নিরাপত্তার চাদরে, শহরের নতুন স্টেডিয়াম নিয়েছিল প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গের চেহারা।

গোয়ালিয়রে কালো পতাকা, কোটলায় কী?
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন টিম বাসে হোটেল থেকে মাঠে যাচ্ছে, শহরের এক প্রান্তে পুলিশের নজর এড়িয়ে ‘বজরং দল’-এর কিছু কর্মী তাদের কালো পতাকাও দেখিয়ে ফেলেন!

তারও আগে শুক্রবার বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা জুমার নামাজ পড়তে মসজিদেও যেতে পারেননি, হোটেলেই তাদের নামাজ আদায় করতে হয়েছে।

অথচ গোয়ালিয়রের ফুলবাগ এলাকায় বিখ্যাত মোতি মসজিদ ছিল তাদের হোটেল থেকে মাত্রই তিন কিলোমিটার দূরে, কিন্তু নিরাপত্তার কারণেই তাদের সেখানে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।

সেই টি-টোয়েন্টি সিরিজেরই দ্বিতীয় ম্যাচ আজ বুধবার (৯ অক্টোবর) রাজধানী দিল্লির অরুণ জেটলি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে, যে মাঠটি ‘ফিরোজ শাহ কোটলা’ নামেই বেশি পরিচিত।

গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া স্টেডিয়াম তবু ছিল মূল শহরের একটু বাইরে, আর ‘কোটলা’ হলো দিল্লির একেবারে কেন্দ্রস্থলে।

স্টেডিয়ামে আসার জন্য মেট্রোরেলসহ গণপরিবহনও খুবই ভালো। ফলে ম্যাচের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আজ দিল্লি পুলিশের দুঃশ্চিন্তাও কম নয়।

চলতি সিরিজের প্রথম পর্বে বাংলাদেশ যখন চেন্নাই ও কানপুরে পরপর দু’টি টেস্ট খেলে, সেখানেও ম্যাচের নিরাপত্তা নিয়ে আয়োজকদের একই রকম সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।

ওই দু’টি ভেন্যুতেও ছিল ম্যাচ ভণ্ডুল করে দেয়ার হুমকি। যদিও ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (বিসিসিআই) শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই টেস্ট দু’টি শেষ করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় দল ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলতে আসছে সেই ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। ওইবার হায়দ্রাবাদে ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। তার আগে ও পরে ভারতে তারা বহুবার এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপেও খেলে গেছে।

কিন্তু এত বছরের মধ্যে ভারতে বাংলাদেশের ম্যাচ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে কখনোই এমন দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি, যেটা এবারে হচ্ছে।

আর একটু অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবতা হলো, এর সাথে কিছুটা সম্পর্ক আছে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের!

‘হিন্দু নির্যাতনকারীদের সাথে ক্রিকেট নয়’
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর থেকেই ‘সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর হামলা’ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তাতে বাংলাদেশে সাথে ভারতের ক্রিকেট খেলাও বর্জন করা উচিত বলে দাবি তুলেছে দেশটির বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।

বাংলাদেশ দল যে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দু’ই টেস্ট ও তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ খেলতে ভারত যাবে, এটা অবশ্য বহু আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে ছিল।

কিন্তু পরের পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত এই সিরিজ বয়কট করা- এমন দাবিতে সরব হয় বেশ কিছু সংগঠন, ক্রিকেট বোর্ডের কাছেও এই মর্মে স্মারকলিপি জমা পড়তে থাকে।

১৯ সেপ্টেম্বর চেন্নাইতে শুরু হয় সিরিজের প্রথম টেস্ট। তার আগে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড করতে থাকে ‘হ্যাশট্যাগ বয়কটবাংলাদেশক্রিকেট’।

হিন্দু মহাসভা, বজরং দল, হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির মতো ভারতের বেশ কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বলতে শুরু করে, বাংলাদেশের সাথে ভারত যদি ক্রিকেট খেলে, তাহলে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগেই আঘাত করা হবে।

ভারত ও ভারতের বাইরে বেশ কয়েকজন দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারও এই দাবিকে সমর্থন জানান। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিক্রম প্রতাপ সিং, অভয় নারায়ণ কুলকার্নি প্রমুখ।

চেন্নাই টেস্টের আগে ওই ম্যাচ বাতিল করার দাবি জানিয়ে গোয়ার হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি বিবৃতি দেয়, ‘বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫২টিতেই হিন্দুরা আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে ক্রিকেট খেলে তার চেয়ে কলঙ্ক ও অমর্যাদার আর কী হতে পারে?’

এই ম্যাচ খেলা হলে তা বাংলাদেশের হিন্দুদের ‘ব্যথার ক্ষতস্থানে আরো খুঁচিয়ে ঘা করা হবে’ বলেও তারা মন্তব্য করে।

গোয়ালিয়রে হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট জয়বীর ভরদ্বাজ আবার তার শহরে ম্যাচ বাতিল করার দাবি জানিয়ে সোজা চিঠি লেখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।

হিন্দু মহাসভা বলে, ‘একদিকে বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করা হবে আর সেই দেশের সাথে আমরা ক্রিকেট খেলব- এ ম্যাচ আমরা কিছুতেই হতে দেবো না।’

কৃষ্ণভক্তদের ধর্মীয় সংগঠন ‘ইসকনে’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও কলকাতা শাখার মুখপাত্র রাধারমণ দাস গত ১৫ সেপ্টেম্বর টুইট করেন, ‘একদিকে যখন ভারতীয় বোর্ড বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে চলেছে, তখন সে দেশের দেয়ালে পিঠ-ঠেকে-যাওয়া হিন্দুরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন- যাতে সারা বিশ্ব তাদের কাতর আর্তি শুনতে পায়।’

ভারতের যে সংগঠনগুলো এই সিরিজ বাতিলের ডাক দিয়েছে তারা যে খুব শক্তিশালী বা প্রভাবশালী তা হয়তো নয়- কিন্তু অন্তত বেশ কয়েক শ’ ক্যাডার বা কর্মী তাদের বিভিন্ন শহরেই রয়েছে।

একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ ভেস্তে দিতে অনেক সময় জনাকয়েক লোকই যথেষ্ঠ। যে কারণে এই সিরিজে নিরাপত্তার দিক থেকে কোনো ঝুঁকিই নিতে পারছে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অবস্থান কী?
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি যখন সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ দল ভারতের মাটিতে পা রাখে, চেন্নাইয়ে ভারতীয় বোর্ডের তরফে তাদের নিয়মমাফিক সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়।

সেই অভ্যর্থনার ভিডিও পোস্ট করে ভারতে অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার লেখেন, ‘ ‘“বিসিসিআই-এর নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকা উচিত।’

এই ধরনের প্ররোচনামূলক বক্তব্য বা সিরিজ বাতিল করার দাবি সত্ত্বেও ভারতীয় বোর্ড অবশ্য তাতে কোনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

বোর্ডের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা সেদিন শুধু বলেছেন, ‘আমাদের জন্য যে বাংলাদেশ সিরিজ ইজ ভেরি মাচ অন- এটা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন। ফলে নতুন করে কী আর বলার আছে!’

এর আগে কানপুরে যখন কোনো কোনো সংগঠন টেস্ট ম্যাচ ভণ্ডুল করার হুমকি দিয়েছিল, বিসিসিআই তাতেও কর্ণপাত করেনি।

বোর্ডের একজন কর্মকর্তা তখন বার্তাসংস্থাকে বলেছিলেন, ‘কানপুর থেকে ভেন্যু সরানো হবে না। বোর্ড কানপুরেই ম্যাচ করবে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তার সাথে ম্যাচ করবে।’

ভারতের প্রবীণ ক্রিকেট সাংবাদিক প্রদীপ ম্যাগাজিন অবশ্য মনে করেন, ভারতীয় বোর্ড যে এই চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সিরিজ বাতিল করেনি- তার প্রধান কারণ হলো ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বা ‘ডাব্লিউটিসি’।

তিনি বলেন, ‘অতীতে রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান সিরিজ বাতিল করার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত ভারতের আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে সেটা হয়নি, তার প্রধান কারণ ভারত ডাব্লিউটিসির ফাইনালে খেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।’

আইসিসির এফটিপি বা ‘ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রামে’ এই সিরিজ অনেক আগেই ঠাঁই পেয়েছে। কাজেই কোনো রাজনৈতিক কারণে ভারত যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে না খেলত তাহলে তাদের বিস্তর পয়েন্ট কাটা যেত এবং ফাইনালে ওঠার সুযোগ নিশ্চিতভাবেই হাতছাড়া হতো।

আর সিরিজে দু’টি টেস্ট খেললে কোনো ‘অজুহাত’ দেখিয়ে বাকি তিনটে টি-টোয়েন্টি না খেলাটা অর্থহীন, যে কারণে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় বোর্ড পুরো সিরিজটাই খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে প্রদীপ ম্যাগাজিন মনে করছেন।

তবে ভারতে কিছু মানুষ এখনো মনে করছেন এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভারতীয় বোর্ডের মোটেই সমীচিন হয়নি, তাদের অনেকে টেলিভিশনেও এই ম্যাচগুলো দেখবেন না বলে সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘোষণা করেছেন।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement

সকল