২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জাহিদুলের স্বেচ্ছাশ্রমে চার জেলায় ৫শ’ বাঁশের সাঁকো

জাহিদুলের স্বেচ্ছাশ্রমে চার জেলায় ৫শ’ বাঁশের সাঁকো - সংগৃহীত

নদী-পারাপারে মানুষের দূর্ভোগের কথা কোনভাবে জানতে পারলেই ছুটে যান জাহিদুল। এলাকার তরুন, যুবক ও বৃদ্ধদের সাথে নিয়ে বাঁশ ও কাঠের সেতু বানিয়ে ফেলেন। আবার কোন কোন এলাকার মানুষ নিজেরাই ফোনে যোগাযোগ করে জাহিদুলের সঙ্গে। নিজের ব্যবহৃত একটি পুরানো বাই সাইকেল নিয়ে হাজির হন তিনি। দিনভর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে সাঁকো তৈরি করার পর রাতের বেলা মসজিদের মাইকে ওয়াজ করেন। ওয়াজ শুনে এলাকার যুবকরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরদিন তার সাথে স্বেচ্ছাশ্রমে আবারও যোগ দিয়ে সাঁকো তৈরীর কাজ শেষ করেন। এভাবেই তিনি কাজ পরের উপকারে কাজ করে যাচ্ছেন।

জাহিদুল ইসলাম সোনাতলা উপজেলার দিগদাইড় ইউনিয়নের দিগদাইড় গ্রামের মৃত মোবারক আলীর ছেলে। তিনি পেশায় লোহাগড়া গ্রামের মসজিদের ইমাম। তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে বায়জিদ বোস্তামি সরকারী আকবর আলী কলেজে গণিত বিভাগে বিএসসি অনার্স বিষয়ে অধ্যয়নরত। মেঝো ছেলে মো. ইস্রাফিল ইসলাম বগুড়ার সরকারী মোস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এবছর আলিম পরীক্ষার্থী। ছোট কন্যা তাবাসসুম আক্তার কর্পূর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এবং স্ত্রী গৃহিনী।

জাহিদুলের বাড়ীর পাশে রয়েছে একটি খাল। আর সেই খাল অতিক্রম করে তাকে যেতে হত বিদ্যালয়ে। এই চরম কষ্ট প্রতিবেশীদের দেখে গ্রামের সবাইকে সাথে নিয়ে এসে খালের উপর একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করলেন। জাহিদুল ১২ বছর বয়স থেকে সমাজসেবামূলক কাজে অবদান রেখে চলেছেন। এখন তার বয়স ৫৩ বছর। তিনি এখন তিন সন্তানের জনক। জাহিদুলের এমন উদ্যোগ নিজ জেলাসহ পার্শ্ববতী গাইবান্ধা, নওগাঁ, জামালপুরসহ অন্যান্য জেলায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশের সাঁকো তৈরি করে মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সৃষ্টি করেছেন।

এ বিষয়ে সাদা মনের মানুষ জাহিদুল ইসলাম নয়া দিগন্ত প্রতিবেদককে জানান, গত ৪০ বছরে স্বেচ্ছাশ্রমে ৪৫০-৫০০টি বাঁশের সাঁকো তিনি তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যে কিছু কিছু এলাকার বাঁশোর সাঁকো নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় সরকারীভাবে আরসিসি ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে।
সোনাতলা উপজেলার দিগদাইড় ইউপি চেয়ারম্যান আলী তৈয়ব শামীম নয়া দিগন্ত প্রতিবেদককে জানান, জাহিদুল ইসলাম একজন মানব দরদী মানুষ। অন্যের বিপদে আপদে ছুটে যান তিনি। নানা রকম সহযোগিতা করে থাকেন। সে আমার ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে ফলজ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষ রোপন করেছেন।

এ বিষয়ে কর্পূর উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাওলানা শামছু উদ্দিন জানান, মানুষের যাতায়াতের জন্য অসংখ্য বাঁশের সেতু সে নির্মাণ করেছে। সে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির ও শ্মশান ঘাটের রাস্তা সংস্কারসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চত্বরে ফলজ, বনজ ও ভেষজ গাছ রোপন করেছেন। তার এ মহান উদ্যোগ ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষী হয়ে থাকবে।

পাশের গাবতলী উপজেলার বটিয়াভাঙ্গা গ্রামের ছামাদ মিয়া নয়া দিগন্ত প্রতিবেদককে জানান, ইছামতি নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করে আসছে। আমাদের যাতায়াতের দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে তিনি এলাকার তরুন, যুবক ও বৃদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে ওই স্থানে একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছেন সেই সাদা মনের মানুষটি জাহিদুল ইসলাম। বর্তমানে ওই সাঁকোর উপর দিয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী সহ পথচারীরা যাতায়াত করে আসছে।

এছাড়াও তিনি আরও জানান, ওই স্থানে বাঁশের সাঁকো নির্মাণে উদ্বোধনের দিন উপস্থিত জনতাকে তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫শ’ টাকা মিষ্টি খাওয়ার জন্য প্রদান করেন।

জাহিদুল ইসলাম বগুড়া জেলায় নতুন ভাবে ১৪-১৫টি মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও ৪-৫টি কবরস্থানে যাতায়াতের জন্য মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণ করেছেন। সোনাতলা উপজেলার কর্পূর, বালুয়াহাট, পাঠানপাড়া, দিগদাইড়, গাবতলী উপজেলার জামিরবাড়ীয়া, ছয়ঘড়িয়া, মধ্যমার ছেঁও, প্রথমার ছেঁও, বটিয়াভাঙ্গা, দূর্গাহাটা, সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, চন্দনবাইশা, ছাগল ধারা, শিবগঞ্জ উপজেলার তালিবপুর, টেপাগাড়ি, অনন্তবালা এলাকায় লোকজনের যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ করেছেন। সে ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে তার একটি পুরাতন বাইসাইকেল যোগে যেখানে এ ধরনের কাজ থাকে সেখানে গিয়ে এসব কাজ করে আসছে।

এছাড়াও সে বাড়ি থেকে কোদাল, দা, খুন্তি, বাঁশের ঝুড়ি কাঁধে বহন করে বাইসাইকেল যোগে এসব বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করার জন্য ছুটে যান।

সোনাতলা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক মন্ডল জানান, কৃষকদের দুঃখ দূর্দশা লাঘব করার জন্য বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ৯৫-১০০টি রেকর্ডবিহীন নতুন রাস্তা নির্মাণ করে এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন।

জাহিদুল ইসলাম বহু বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। কোথাও কোন বাল্য বিবাহের সংবাদ পেলে ছুটে যান সেখানে। পিতামাতাকে বুঝিয়ে শিশু সন্তানকে বাল্য বিবাহের হাত থেকে রক্ষা করে বিদ্যালয় মুখী করান। এ জন্য দিগদাইড় ইউপি চেয়ারম্যান আলী তৈয়ব শামীম তাকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য পদে রেখেছেন। অসহায়, হতদরিদ্র, কন্যাদ্বায়গ্রস্থ পিতামাতাকে তিনি তার সাধ্যমত সহযোগিতা করে থাকেন।

জাহিদুল ইসলাম রাস্তার পাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদের আঙ্গিনায়, সরকারী জায়গায় এ পর্যন্ত ৫০ হাজার তাল গাছের চারা সহ অসংখ্য বৃক্ষ রোপন করেছেন। দিগদাইড় ইউনিহেল্প উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রতন মিয়া ও সৈয়দ আহম্মদ মডেল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা রুহুল আমিন জানান, জাহিদুল ইসলাম নিজ খরচে এসব গাছ লাগিয়েছেন।

এ ব্যাপারে সোনাতলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মিনহাদুজ্জামান লীটন জানান, জাহিদুল ইসলাম বগুড়া জেলাসহ আশপাশের আরও ৩টি জেলায় এসব সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তার এ মহান উদ্যোগ তিনি স্বাগত জানান।


আরো সংবাদ



premium cement