১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রাতভর রেমালের তাণ্ডব, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে

রাতভর রেমালের তাণ্ডব, সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে - সংগৃহীত

পুরো রাতজুড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে তাণ্ডব চালিয়েছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। মধ্যরাতে ঝড়ের সাথে জলোচ্ছ্বাসে তলিয়েছে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরের বেশ বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙ্গেছে গাছ পালা, বাড়িঘর, বেড়িবাঁধ। দক্ষিণ অঞ্চলের অনেক মাছের ঘের তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

বর্তমান ঘূর্ণিঝড় রেমাল খুলনা ও কয়রার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এটি আরো উত্তরদিকে অগ্রসর হচ্ছে।

সোমবার সকালে আবহাওয়া অধিদফতরের বিশেষ বুলেটিনে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় রেমাল সকাল আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ বৃষ্টিপাত ঝরিয়ে সকাল ১১টা নাগাদ দুর্বল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা নাগিব বাহার জানিয়েছে, ‘রোববার মধ্য রাতে মূল ঝড়টি আঘাত হানে সাতক্ষীরা উপকূলে। এ সময় অনেকে বাড়িঘড় ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটতে শুরু করে।’

রোববার মধ্যরাতে থেকে ভোররাত পর্যন্ত দক্ষিণ উপকূলে তাণ্ডব শেষে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়টি। সকাল ৭টার পর থেকে আবারো ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টিপাত শুরু হয় বিভিন্ন এলাকায়।

পেশাগত কাজে বাগেরহাটের মোংলায় অবস্থান করছিলেন বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী রামিম হাসান। তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে সকাল ৮টায় ঝড়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানান বিবিসি বাংলার কাছে।

তিনি জানান, রাত ১২টার পর থেকে জোয়ারের সাথে পানি বাড়তে থাকে, সেই সাথে বাড়ছিল ঝড়ের তীব্রতা। মোংলার নিচু এলাকার বেশিরভাগ বাড়িঘর-দোকান পাট পানিতে তলিয়ে গেছে। আর সকাল থেকে ঝোড়ো বৃষ্টিতে পানিবন্দী অবস্থায় আছে এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ।

বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা জানান, সড়কের বেশিরভাগ জায়গায় গাছ পড়ে আছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে অনেক এলাকা। বাঁধ ভেঙ্গে পানি ঢোকায় পানিবন্দী খুলনা ও বরিশাল বিভাগের নিচু এলাকার লাখো মানুষ।

ঝড়ের তীব্রতা এখনো না কমায় মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি রেখেছে আবহাওয়া অধিদফতর।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভোর থেকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখা যায় রাজধানী ঢাকায়। ভোর ৬টা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে বাড়তে থাকে বৃষ্টি।

মধ্যরাতে রিমালের তাণ্ডব
ঘূর্ণিঝড় রিমালের অগ্রভাগ আঘাত হানা শুরু করে রোববার সন্ধ্যা থেকে। তখন আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছিল মধ্যরাত নাগাদ এটি উপকূল ও স্থলভাগ অতিক্রম করবে।

অনেকেই ভেবেছিল মধ্যরাতের মধ্যে ঝড় থেমে যাবে। কিন্তু মধ্যরাতের পরই শুরু হয় মূল ঝড়।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ তখন ছিল ৯০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে মিঠুন কুমার শিকারী রাতে পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘এখন রাত ২টা বাজে, সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে।’

মধ্যরাতে রেমালে তাণ্ডবে খুলনা বাগেরহাট সাতক্ষীরার বেশিরভাগ রাস্তায় ভেঙ্গে পড়ে বড় বড় গাছ। সকালে দেখা যায়, বেশিরভাগ রাস্তায় ভেঙ্গে পড়ে আছে বড় বড় গাছ।

ঝড় ও বৃষ্টির তীব্রতা না কমায় অনেক এলাকার সড়ক থেকে সরানো যাচ্ছে না গাছ। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা।

বাগেরহাট সদরের বাসিন্দা গাজী রেজওয়ান শাতিল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গতকাল রাত ১১টা থেকে শুরু হয়ে এখনো তাণ্ডব চলছে। বাগেরহাট শহরের রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাগেরহাটের বেশিরভাগ মাছের ঘের তলিয়ে গেছে।’

গাছের সাথে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুটি ভেঙ্গে পড়েছে রাস্তায়।

বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ব্যহত হওয়া অনেকেই ঢাকা থেকে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানাচ্ছেন।

মাসুদ রায়হান পলাশ নামে এক ব্যক্তি ফেসবুক পোস্টে জানান, তার পরিবারের সাতক্ষীরায় থাকে। রোববার রাত থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ফোনে পাচ্ছেন না।

জলোচ্ছ্বাসে ডুবেছে দক্ষিণাঞ্চল
রোববার সন্ধ্যার পর ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ যখন উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে তখন সে সব এলাকার সমুদ্র ও নদীতে ভাটা চলছিল। যে কারণে ঝড়ের সাথে খুব জলোচ্ছ্বাস তৈরি হয়নি।

নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রোববার রাত ৯টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় জোয়ার। নদী খালে আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে পানি।

রাত ২টা নাগাদ ঝোড়ো বাতাসের সাথে পূর্ণ জোয়ারের একে একে প্লাবিত হতে থাকে নদী ও তীর ও আশপাশের এলাকা।

বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ থেকে আকাশ ইসলাম নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান, মোড়েলগঞ্জের প্রতিটি ঘরের মেঝেতে পানি ছুইছুই। কিছু ঘরের ভেতর পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে।

এমন বেশ কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে অনেক পাকা ঘরের খাটের ওপর পর্যন্ত পানি উঠেছে। এতে বিছানা তোষক, ফ্রিজ আসবাবপত্র সব তলিয়ে গেছে।

পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি থেকে আব্দুল গাফফার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মধ্যরাতের পরে খালে জোয়ারের পানি এতটাই বেড়েছে যে পুকুর, খাল, নদী, বাড়ির মেঝে সব তলিয়ে গেছে’।

ঘূর্ণিঝড় সিডরেও এত পানি ওঠেনি বলে জানান তিনি।

বাঁধ ভাঙছে, ডুবছে মাছের ঘের
বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনার বিস্তীর্ণ এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাধ রয়েছে। এর মধ্যে অনেক আগে থেকেই অনেক বাঁধ ছিল ঝুকির মুখে।

এসব এলাকায় বর্তমানে চলছে মাছের মৌসুম। সোমবার তীব্র শুরু হওয়ার পর মধ্যরাতের স্বাভাবিকের চেয়ে সাত-আট ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ারের চাপে সাতক্ষীরা, বরগুনাসহ কয়েক জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা গেছে।

উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম।

খুলনার কয়রার স্থানীয় সাংবাদিক ওবায়দুল কবির সম্রাট বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গতকাল রাত থেকেই বাঁধের ওপর থেকে পানি আসতে শুরু কয়রার বিভিন্ন এলাকায়।’

সম্রাট জানান, সোমবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ১০টি পয়েন্ট থেকে বাঁধের ওপর দিয়ে পানি ঢুকে তলিয়ে যেতে শুরু করে বিশাল এলাকা। এখন পর্যন্ত ঝড়ের কারণে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি, মহিষাপুর ও কয়রা সদর ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকার বাঁধ উপচে পড়ে ও ভেঙ্গে গিয়ে পানি ঢুকছে।

পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অন্তত পাঁচ ফুট পানি বাড়লে বরগুনার আমতলী উপজেলার বালিয়াতলী ও পশুর বুনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক আবু জাফর সালেহ।

এই এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৩০০ ফুট ভেঙে গেছে। এর ফলে বালিয়াতলী ও পশুরবুনিয়া গ্রাম ২-৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে বোরো ধানের ক্ষেত।

এছাড়া তালতলী উপজেলার তেতুরবাড়িয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ৩-৪ জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে সেখানে কয়েক শত পরিবার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের মুল বাঁধটি অক্ষত থাকলেও টেকসই বেড়িবাঁধ রক্ষায় নির্মিত রিং বাঁধটি ভেঙে গেছে।

বাগেরহাটের বেশিরভাগ মাছের ঘের পানির নিচে ডুবতে শুরু করেছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক গাজী রেজওয়ান শাতিল।

ঝড়ের প্রভাব রাজধানীতে
রোববার রাতেই আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।

সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় আবহাওয়া অফিস জানায়, প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ -এর প্রভাবে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করে বর্তমানে কয়রা, খুলনার নিকট অবস্থান করছে।

এটি আস্তে আস্তে উত্তর দিকে অর্থাৎ প্রভাবে রাজধানীতে সোমবার ভোর থেকে ঝরছে বৃষ্টি।

এর প্রভাবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি ও বাতাস চলছে।

সকালের বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক এলাকার রাস্তাঘাটে পানি জমেছে।

সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে অফিসগামী রাজধানীবাসীদের। কেন না যানবাহন পেতে অনেককে পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি।

রেমাল গভীর নিম্নচাপে পরিণত

সোমবার আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতিতে বলা হয়েছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল উত্তর দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপ হিসাবে বর্তমানে যশোর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরো উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ বৃষ্টিপাত ঝরিয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে।

এদিকে আরো বলা হয়েছে, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ০৩ (তিন) পুনঃ ০৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ (নয়) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ০৩ (তিন) পুনঃ ০৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে আগামীকাল সকাল (২৮ মে ২০২৪) পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে এবং সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement