১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের শিক্ষা প্রশাসনে পদায়ন

ত্যাগী ও বঞ্চিতদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ
-

বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের সাথে জড়িত এবং বিতর্কিত ও সুবিধাভোগীরাই পদায়ন পাচ্ছেন শিক্ষা প্রশাসনে। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ও ত্যাগী কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিতই হচ্ছেন। এ নিয়ে গত কয়দিন ধরে শিক্ষা প্রশাসনে তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধছে। বিগত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব কর্মকর্তা ধরাকে সরাজ্ঞান করে নানা ধরনের অনিয়ম করেছেন তারাই এখন ঘুরে ফিরে পদোন্নতি নিয়ে পদায়নও পাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ঢাকা অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন মোসা: রেবেকা সুলতানা। অথচ এই রেবেকার বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছিল মাউশির সাবেক ডিজি অধ্যাপক গোলাম ফারুকের কাছে। অভিযোগ রয়েছে রেবেকার দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নিজে অনেকবার শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ, দীপু মনি ও মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবদের তদবিরও করেছিলেন।
এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে শিক্ষা প্রশাসনে একযোগে ৬৭ জন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত সুবিধা নিয়ে সরকারের দলীয় লোক হিসেবে শিক্ষাকে ধ্বংস করার চক্রান্তে নিয়োজিত ছিলেন। নতুন ওই পদায়নের তালিকায় দেখা গেছে এমন সুবিধাবাদী অনেককেই প্রমোশনও দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পদায়নের এই তালিকায় রয়েছেন বিতর্কিত কারিকুলাম প্রণয়নের মূল হোতা ড. মশিউজ্জামানের একান্ত সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একাধিক সদস্য। তারাও এখন নতুনভাবে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন।
বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পলায়নের পর নতুন বিপ্লবী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার নেয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন। আর এই দুরূহ কাজটি মূলত সম্পাদিত হবে এনসিটিবির মাধ্যমেই। এরই মধ্যে নতুন পদায়নের তালিকায় এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং কুমিল্লার হোমনা সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে সংযুক্ত থাকা মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদির স¤্রাট। অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তা শেখ মুজিবের অন্ধ অনুসারী এবং বিভিন্ন সময়ে তিনি ফেজবুকে এমনসব স্ট্যাটাস দিতেন যা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ছিল পুরো শিক্ষা প্রশাসনের জন্যই আপত্তিকর ও অসৌজন্যমূলক। তাকেই এখন এনসিটিবির প্রধান সম্পাদকের মতো একটি স্পর্শকাতর দায়িত্বে বসানো হয়েছে।
২০২০ সালের ৫ মার্চ ফেজবুকে দেয়া একটি পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে মাপতে পারছি না। তিনি লিখেছেন, আমারতো মনে হয় বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু নয় বরং পুরো দেশটাই বঙ্গবন্ধু। অথচ এখন দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই কর্মকর্তা ভোল পাল্টিয়ে এনসিটিবির মতো একটি প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনার প্রধান দায়িত্বেই বসে গেছেন। অপরদিকে সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ পদে পদায়ন পেয়েছেন বিতর্কিত শিপ্রা রানী মন্ডল। তিনি একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এর আগে এই শিপ্রা রানী মন্ডলের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগও ছিল। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল এই শিপ্রা রানী জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের অন্যায় কাজে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছেন এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ছাত্র লীগকে উসকানি দিয়েছেন। তিনি নিজেও ছাত্রজীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে এই শিপ্রা ইসকনের একজন সক্রিয় সদস্য।
রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন শিক্ষা প্রশাসনের বিতর্কিত ও আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী ড. মো: আনারুল হক প্রাং। এর আগে রাজশাহীর শহীদ বুদ্ধিজীবী সরকারি কলেজের তিনি ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ ছিলেন। আবুল বাশার ভুঁঞা পদায়ন পেয়েছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ছিলেন আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগীর একজন। কবি নজরুল কলেজে পদায়ন পেয়েছেন হাবিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের বিশেষ সুবিধা নিয়ে তিনি সব সময়ই চাকরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজে পদায়ন পেয়েছেন তামান্না বেগম। শিক্ষা প্রশাসনে এই কর্মকর্তা ব্যাপক আলোচিত। তিনি হলেন উপরে উল্লিখিত শিপ্রার বান্ধবী।
এস এম আমিরুল ইসলাম (ডাক নাম পলাশ) পদায়ন পেয়েছেন সরকারি তোলারাম কলেজে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। একটি সময়ে তিনি ছাত্রলীগের সহসভাপতির পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন পলাশ। আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক থাকায় তিনি দীর্ঘ সময় ঢাকাতেই পোস্টিং নিয়ে চাকরি করেছেন। জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত শামসুন্নাহার পদায়ন পেয়েছেন ইডেন মহিলা কলেজে। দীর্ঘদিন তিনি আওয়ামী লীগের সুবিধা নিয়েছেন। এখনো তিনি নানাভাবে সুবিধা নেয়ার তদবির করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনির আশীর্বাদপুষ্ট প্রফেসর নুরুল বাসেত পদায়ন পেয়েছেন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে। অভিযোগ রয়েছে এই নুরুল বাসেত দীপু মনির ঘনিষ্ঠজন রতন কুমার মজুমদারের সাথে নানা অনিয়মে যুক্ত হয়ে তিনি নিজেও নিয়েছেন অন্যায় সুযোগ সুবিধা।
শিক্ষা প্রশাসনে এমন বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদায়নের বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্বপাদক মো: মাঈন উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, শিক্ষা প্রশাসনে নতুন করে পদায়নের ক্ষেত্রে আরো বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের কোনো সুবিধাভোগী যেন বঞ্চিতদের স্থানে পদায়ন হতে না পারে সে বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে অনেক যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের তাদের ন্যায্য পদ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখন যেন তাদের সেই মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অন্যথায় শিক্ষা প্রশাসনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তা বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ দিনের দমন নিপীড়নের পরে দেশে এখন যে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সরকারকে তাদের প্রত্যেকটি কাজে কর্মে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। উল্লেখ্য, গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে শিক্ষা প্রশাসনে বিভিন্ন পদে তিনটি আদেশে মোট ৬৭ জন (৯+১২+৪৬) কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক কর্মকর্তাই বিতর্কিত এবং তারা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বলে অভিযোগ রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement