ঋণের বোঝা বাড়ছে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশের
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৫ মে ২০২৪, ০২:০১
জিএসএফ অনুদানের পরিবর্তে অধিক পরিমাণ ঋণ প্রদানের ফলে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ওপর ঋণ পরিশোধের বোঝা বাড়ছে। গত এক দশকে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিএসএফ) বা সবুজ জলবায়ু তহবিলের ভূমিকা হতাশাজনক। জিসিএফ স্বীকৃত ‘তহবিল পাওয়ার যোগ্য’ ১৫৪টি দেশের মধ্যে ২৫টি (১৬.২ শতাংশ) দেশ প্রকল্প পায়নি বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, উন্নত দেশ কর্তৃক প্রতিশ্রুত জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টি স্বেচ্ছামূলক হওয়ায় অপর্যাপ্ত তহবিল সরবরাহ এবং বাংলাদেশসহ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিল পাওয়া অনিশ্চিত। রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সবুজ জলবায়ু তহবিলে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অভিগম্যতা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বক্তব্য রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির গবেষক নেওয়াজুল মাওলা ও সহিদুল ইসলাম গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, জিএসএফে জবাবদিহিতা করার মতো কোনো অবকাঠামো নেই। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব নীতিমালা লঙ্ঘন করছে ও বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। জিএসএফের ত্রুটি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের দেন-দরবারের সুযোগ রয়েছে।
টিআইবি তার প্রতিবেদনে বলছে, জাতীয় প্রতিষ্ঠানসহ জলবায়ু তহবিল নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে জিসিএফ তহবিলে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি, প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া ও অর্থ ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ রয়েছে। জিসিএফ সেকেন্ড পারফরম্যান্স রিভিউ-২০২৩ অনুসারে, জিসিএফ তহবিলে অভিগম্যতা পাওয়ার প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বিভিন্ন প্রতিবেদনে তহবিলটির স্বীকৃতি প্রক্রিয়া, প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থছাড় সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ আলোচিত হলেও এর কার্যক্রমে সুশাসন বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। টিআইবি বলছে, দুর্নীতি প্রতিরোধে জিসিএফের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি থাকলেও ইউএনডিপির মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের জিসিএফসহ জলবায়ু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ অমীমাংসিত রেখে বিতর্কিতভাবে জিসিএফ তাদের পুনঃস্বীকৃতি প্রদান করেছে। এমনকি জিসিএফ ইউএনডিপিকে সর্বোচ্চসংখ্যক প্রকল্পও (৩৮টি) অনুমোদন দিয়েছে।
তহবিল বরাদ্দের নির্ধারিত নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না উল্লেখ করে টিআইবি জানায়, জিসিএফ তহবিলের শুরু থেকে অভিযোজন এবং প্রশমন থিমে বরাদ্দে ৫০:৫০ অনুপাত বজায় রাখার লক্ষ্যমাত্রা গত আট বছরে অর্জিত হয়নি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়সীমাও উল্লেখ করা হয়নি। প্রশমন থিমে (৫৬ শতাংশ) অধিক বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। যেখানে অভিযোজন থিমে বরাদ্দের পরিমাণ ৪৪ শতাংশ। অভিযোজনের জন্য ৫.৯ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করা হলেও এর উল্লেখযোগ্য অংশ ক্রস-কাটিং (অভিযোজন ও প্রশমন একত্রে) হিসেবে অনুমোদন করা হয়েছে। ক্রস-কাটিংয়ের ক্ষেত্রে অভিযোজন ও প্রশমন থিমে অনুমোদিত অর্থের পরিমাণ স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা হয় না। শুধু অভিযোজনের জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার (২৫.৮ শতাংশ) অনুমোদন করা হয়েছে। অভিযোজন প্রকল্পগুলো বেশির ভাগই অনুদানভিত্তিক হওয়ায় এই বাবদ বরাদ্দকৃত তহবিল পুনঃবিনিয়োগের সুযোগ নেই। ফলে ঋণভিত্তিক প্রশমন প্রকল্প অনুমোদনে জিসিএফের অধিক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। জিসিএফ কর্তৃক তহবিল বরাদ্দে অগ্রাধিকার প্রদানে ঘাটতির কথা জানিয়ে টিআইবি বলছে, অঞ্চলভিত্তিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, জিসিএফ স্বীকৃত ‘তহবিল পাওয়ার যোগ্য’ ১৫৪টি দেশের মধ্যে ২৫টি (১৬.২ শতাংশ) দেশ প্রকল্প পায়নি। জিসিএফ ‘তহবিল পাওয়ার যোগ্য’ দেশগুলোর মধ্যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সর্বোচ্চ (১৪টি দেশ) সংখ্যক দেশ প্রকল্প পায়নি। আফ্রিকা অঞ্চলের ছয়টি দেশ প্রকল্প পায়নি। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ও পূর্ব ইউরোপ অঞ্চলের যথাক্রমে একটি করে দেশ প্রকল্প পায়নি। এ ছাড়া জিসিএফ কর্তৃক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ‘বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ’ ৯৬টি দেশের মধ্যে আটটি দেশ প্রকল্প পায়নি। জিসিএফের নীতি অনুসারে ‘বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশের জন্য অভিযোজন তহবিল বরাদ্দে গুরুত্ব দেয়া হলেও ৪২টি দেশে অভিযোজন অর্থায়ন হয়নি। যে ক’টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে অভিযোজনের অর্থায়ন হয়েছে তার বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশ অভিযোজন তহবিল প্রাপ্তিতে জিসিএফ থেকে যে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, তা স্বল্পোন্নত ক্যাটাগরির বাইরে গেলে পাবে না।
এসব দেশে জলবায়ু ঝুঁকি একই রকম এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি হলেও তাদের নিয়ে জিসিএফের নতুন অগ্রাধিকার গ্রুপ তৈরির কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের তথ্য তুলে ধরে টিআইবি বলছে, জসিএফে তহবিল প্রস্তাব জমা থেকে বোর্ড অনুমোদন পর্যন্ত নির্ধারিত সময় সর্বোচ্চ ১৯০ দিন হলেও গড়ে ৩৮৯ দিন ব্যয় হয়, যেখানে সর্বনিম্ন ৪২ দিন ও সর্বোচ্চ ১৯৪৫ দিন ব্যয় হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর গড়ে ১৯৯ দিন অতিরিক্ত ব্যয় হয়। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত সময়ের মাঝে তহবিল প্রস্তাব অনুমোদন পায় না। ৭৯.৮ শতাংশ তহবিল প্রস্তাব নির্ধারিত সময়ে অনুমোদন পায়নি। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যেখানে তহবিল প্রস্তাব গ্রহণ থেকে প্রকল্প অনুমোদন পর্যন্ত গড় সময় প্রয়োজন হয় ৪১৩ দিন, সেখানে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গড়ে ৩৭৯ দিন প্রয়োজন হয়। অন্য দিকে এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের জন্য গড় সময় প্রয়োজন হয় ৪৩৩ দিন। জিসিএফের অভিযোগ ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি সম্পর্কে টিআইবি প্রতিবেদন বলছে, জিসিএফের অভিযোগ ব্যবস্থাপনা এখনো বিকাশমান পর্যায়ে রয়েছে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে চলার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকৃতি, প্রকল্প অনুমোদন ও অর্থ ছাড়সহ যোগাযোগসংক্রান্ত বিষয়ে জিসিএফ সচিবালয়ের অসহযোগিতা ও দীর্ঘসূত্রতা বিষয়ে কোনো অভিযোগ প্রদান করে না। স্থানীয় জনগণের সরাসরি অভিযোগ প্রদানের সুযোগের ঘাটতি রয়েছে। এমনকি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অভিযোগ করলেও তার বিষয়বস্তু গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না। নারী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কর্তৃক অভিযোগ প্রদানে জিসিএফের সাথে সরাসরি ও সহজে যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। জিসিএফের অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। বাংলাদেশের একটি প্রকল্প সম্পর্কে টিআইবি ২০১৭ সালে অভিযোগ করলেও জিসিএফ অভিযোগের বিষয়বস্তু যথাযথভাবে আমলে নেয়নি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা