১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সনদপত্রের বাধ্যবাধকতায় জামানত হারাচ্ছে কুবির হাজারো শিক্ষার্থী

-

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের দেয়া জামানতের অর্থ বছর পেরোতেই চলে যায় সরকারি কোষাগারে। যা নির্দিষ্ট সময়পর কিছু শিক্ষার্থীর পক্ষে তুলে নেয়া সম্ভব হলেও প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর পক্ষে কখনোই তোলা সম্ভব নয়। যার পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা। এর জন্য ‘স্নাতকোত্তরের সনদপত্রে’র বাধ্যবাধকতা অন্যতম প্রধান কারণ বলে জানা যায়।
ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রতি বছর ১০৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। যাদের প্রত্যেককে ভর্তির মূল ফির সাথে এক হাজার টাকা (ফেরতযোগ্য) লাইব্রেরি জামানত বাবদ জমা দিতে হয়। সে হিসাবে ২০২০-২১ সেশন অবধি ভর্তি হওয়া ১১ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী (রেজিস্ট্রার দফতরের তথ্যমতে) ১১ কোটি ৬৬ লাখ এক হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছে, যার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় দেখিয়ে ইউজিসির কোষাগারে জমা প্রদান করা হয়েছে। অন্য দিকে এই ফেরতযোগ্য অর্থের মধ্যে মাত্র ৪০১ জন শিক্ষার্থীকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র চার লাখ এক হাজার টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। তবে স্নাতকোত্তর শেষ করা যেকোনো শিক্ষার্থী চাইলে এই অর্থ ফেরত পেতে পারেন বলে জানা যায়। সে ক্ষেত্রে তাকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আবেদন করতে হবে। কিন্তু যারা স্নাতকোত্তর শেষ করতে পারেননি। অর্থাৎ শুধু স্নাতক কুবি থেকে করেছেন কিংবা স্নাতকোত্তরের আগে ভর্তি বাতিল করেছেন বা নানান প্রতিকূলতায় ঝরে গেছেন তারা চাইলেও জামানতের অর্থ ফেরত পাবেন না। কারণ জামানতের অর্থের জন্য করা আবেদনপত্রের সাথে স্নাতকোত্তরের সনদপত্রের ফটোকপি বাধ্যতামূলক জমা দিতে হয়।
রেজিস্ট্রার দফতরের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত আট শতাধিক শিক্ষার্থী স্নাতকের আগেই ভর্তি বাতিল করেছেন। ভর্তি বাতিল না করে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রায় এক শ’ (তাদের মতে)। এ ছাড়াও স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স না করা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০০ শিক্ষার্থীর পরিশোধ করা জামানতের ১০ লাখ টাকা চলে গিয়েছে সরকারি কোষাগারে। যা কাজে আসছে না বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষার্থীদের কোনো উন্নয়নে। আবার ভর্তি বাতিলকৃত শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য অর্থ থেকে। বিষয়টি নিয়ে অর্থ ও হিসাব দফতরের উপপরিচালক মো: আবু তাহের বলেন, অর্থপ্রদানের এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি। যার জন্য কমপক্ষে দুই-তিন মাস সময় কমপক্ষে লেগে যায়। এইজন্য অনেকে আবেদন করেন না মনে হচ্ছে। জামানতের অর্থ সরকারি কোষাগারে চলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি বছর ইউজিসিকে আমাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয় দেখাতে হয়। তাই আমরা শুরু থেকেই অন্যান্য আয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের জামানতটাও সরকারি কোষাগারে পাঠিয়ে দেই। আবার কেউ টাকার জন্য আবেদন করলে নতুন যারা ভর্তি হয়েছে সেখান থেকে দিয়ে দেই।
কিন্তু ইউজিসিকে দেয়া শিক্ষার্থীদের জামানতকৃত অর্থের পরিমাণ কিংবা ভর্তি বাতিলকৃত শিক্ষার্থীদের অর্থের পরিমাণের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ ও হিসাব দফতরের দায়িত্বরত কেউই তার সঠিক পরিমাণ বলতে পারেননি। তাদের ভাষ্য, তারা ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের পুরো অর্থ একটা হিসাব নম্বরে ব্যাংকে জমা রাখেন। যদিও ভর্তিচ্ছুদের থেকে ভর্তি, বেতন, জামানত, খেলাধুলা, ছাত্রছাত্রী কল্যাণ ও প্রক্টোরিয়াল সার্ভিস ফিসহ ২০-২৫টি হিসাব দেখিয়ে অর্থ নিয়ে ভর্তি করান।
শিক্ষার্থীদের থেকে নেয়া জামানত এভাবে সরকারি কোষাগারে জমাদানের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে সাবেক ও বর্তমান ১০ জন শিক্ষার্থী জানান, জামানতের অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সনদপত্র বাধ্যবাধকতার এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার। তাদের টাকা ফিরিয়ে দেয়া হোক। অথবা কেউ যদি অর্থের দাবিদার না হয় তাহলে সে টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ফান্ড করে দেয়া হোক। যেখান থেকে প্রতি বছর অসুস্থ হওয়া কিংবা দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যেন আর্থিক সহায়তা পেতে পারেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা পরিচালক ড. মোহা: হাবিবুর রহমানও শিক্ষার্থীদের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জামানতের অর্থ সরকারি কোষাগারে পাঠানো হয়ে থাকলে এ নিয়মে পরিবর্তন আনা উচিত। এই অর্থ অসুস্থ, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমি অর্থ দফতরে কথা বলব।
এ দিকে নিরাপত্তার অজুহাতে লাইব্রেরির জামানত নেয়া হলেও, ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান মহিউদ্দিন মোহাম্মদ তারেক ভূঁঞার ভাষ্যনুযায়ী এই অর্থের বিষয়ে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না। উল্টো তারা লাইব্রেরির নিরাপত্তার স্বার্থে লাইব্রেরি বিধি অনুযায়ী আলাদাভাবে ফি নিয়ে থাকে এবং জরিমানা করে থাকে।
লাইব্রেরি জামানত ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে হলের আবাসিকতা বাবদ ৬০০ টাকা জমা দিতে হয়। তাও কেউ আবেদন না করলে সরকারি কোষাগারে চলে যায় বলে জানা যায়। তবে এক ফান্ডের টাকা অন্য ফান্ডে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহার করতে গেলে অনিয়ম হবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো: আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জামানতের যেই অংশটা তাদের পক্ষে নেয়া সম্ভব না সেটার দাবিদার একমাত্র রাষ্ট্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই এই পদ্ধতি চালু আছে। এটা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি ভিসি স্যার ও ট্রেজারার সাহেবের সাথে বসে আলোচনা করব। তবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জামানতের হিসাব দেখিয়ে নেয়া অর্থ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করার অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। ভর্তি বাতিলকৃত শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য সব খাতের টাকা একটি হিসাব নম্বরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা খাতের জন্য আলাদা আলাদা হিসাব নম্বর থাকা উচিত। একটা হিসাব নম্বরে সব অর্থ রাখা সুন্দর সিস্টেম হতে পারে না।


আরো সংবাদ



premium cement