১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
অছাত্র, চাকরিজীবী ও বিবাহিতরা দায়িত্বে, ক্ষুব্ধ পদপ্রত্যাশীরা

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে চলছে কুবি ছাত্রলীগ

-

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না করার অঙ্গীকার করার পর ভর্তি হয়েই রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ভর্তি ফরমে রাজনীতি না করার অঙ্গীকার দিয়েই ভর্তি হতে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ সক্রিয় রয়েছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কমিটি থাকলেও ছাত্রলীগের রাজনীতিই মূলত সরব এখানে।
ক্ষমতার একচ্ছত্রে থাকা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বিরাজ করছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অছাত্র, চাকরিজীবী এবং বিবাহিতদের নিয়েই চলছে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি, যা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বহু আগেই। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ নতুন পদপ্রত্যাশীরা। তারা বলছেন, দীর্ঘ দিন ছাত্রলীগের রাজনীতি করে যখন নেতৃত্বের স্বাদ নেয়ার কথা, তখন শুধু একজন সিনিয়র কর্মী হিসেবে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয় আমাদের। বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জার। যদিও অভিযোগ মানতে নারাজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। তাদের দাবি, করোনার কারণে দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একই চিত্র। আমরা বর্তমানে অনুষদ কমিটি দিচ্ছি। ক্রমান্বয়ে সব কমিটি নবায়ন করা হবে।
২০১৭ সালের ২৬ মে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইলিয়াস হোসেন সবুজকে সভাপতি ও গণিত বিভাগের ষষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থী রেজাউল ইসলাম মাজেদকে সাধারণ সম্পাদক করে এক বছরের জন্য ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি অনুমোদন দেয়। একই বছরের ২২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়। সে হিসেবে এই কমিটির মেয়াদ ফুরিয়েছে ২০১৮ সালেই।
জানা যায়, বর্তমান কমিটিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বেশির ভাগ নেতা অছাত্র, চাকরিজীবী ও বিবাহিত। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম ব্যাচ শিক্ষা কার্যক্রম চুকিয়ে বের হয়ে গেলেও বর্তমান সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ব্যাচের ছাত্রই রয়েছেন। বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়ে নামকাওয়াস্তে ছাত্রত্ব ধরে রেখেছেন সভাপতি।
এ দিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী এক নেতা বলেন, বর্তমানে কর্মীদের মাঝে কোনো আশা নেই। কারণ বছরের পর বছর ছাত্রত্বহীন নেতারা সভাপতি-সম্পাদক হয়ে আছেন। আমি এখন এ বিষয়ে কথা বলছি, এটা যদি কেউ জানতে পারে, তাহলে আমি হয়তো এ ক্যাম্পাসে আর আসতে পারব না। বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। সভাপতি-সম্পাদকের বিষয়ে কেউ কথা বললে হয় সে শিবির হবে, নয়তো সে ছাত্রদল হয়ে যাবে। এর আগে যারাই কথা বলেছে, তারা এখন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে পদপ্রত্যাশী প্রতিপক্ষের বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে মারধর করে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মহিউদ্দিন নাবিল, ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও জয়নাল আহমেদকে সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের কক্ষে ডেকে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন করা হয়। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদের কক্ষে (৩০১) শিবির-ছাত্রদল নিধন নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়। এমনকি তাদের সাথে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে সে সময়। তার কক্ষেই ২০১৭ সালের ৫ জুন গণিত সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাপ্তুন চৌধুরী ও পরিসংখ্যান অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেনকে ডেকে নিয়ে শিবির আখ্যা দিয়ে মারধর করা হয়। এ ছাড়াও গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মমিন শুভ নামের প্রতিপক্ষ গ্রুপের এক কর্মীকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বেধড়ক মারধর করে হল থেকে বের করে দেয়। এ বছরের ২ মার্চ পূর্বঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের একাদশ আবর্তনের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল হাওলাদারকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ দিকে বর্তমান কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্র ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অনুপস্থিতির। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন টেন্ডার এবং চাঁদাবাজিতে মত্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এ দিকে বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে চরম শূন্যতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি লোকপ্রশাসন বিভাগের ষষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থী এস এম শাহাদাত রহমান তারেক চাকরিতে যোগদান করেছেন দায়িত্ব পাওয়ার পরই। একই বিভাগের সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ ওয়াহিদ থাকলেও ২০১৮ সালেই শেষ হয়েছে তার ছাত্রত্ব। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সৌরভ চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে হলত্যাগ করেছেন ২০১৯ সালে। একই চিত্র কাজী নজরুল ইসলাম হলেও। অপর দিকে একমাত্র ছাত্রী হলে আজ পর্যন্ত দেয়া হয়নি কোনো কমিটি। বঞ্চিত নেতাদের অভিযোগ, বর্তমান সভাপতির সাংগঠনিক কার্যক্রমের চেয়ে অর্থলিপ্সু মনোভাবের কারণে এমন ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করেন বর্তমান সভাপতি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে ছাত্রলীগের পদধারী বিভিন্ন নেতাকে নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো নখদর্পণে রাখেন তিনি। ফলে অন্যান্য কর্মকর্তা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হন। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, করোনার কারণে শুধু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একই চিত্র। আমরা বর্তমানে অনুষদ কমিটি দিচ্ছি। ক্রমান্বয়ে সব কমিটি নবায়ন করা হবে। প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের মারধরের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তারা তাদের অপকর্মের কারণে ছাত্রলীগ থেকে বিচ্ছিন্ন।
তবে অছাত্র, চাকরিজীবী ও বিবাহিতদের কমিটিতে না রাখতে কঠোর অবস্থানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। নতুন কমিটি গঠনের জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাথে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে তরুণ ও নতুন নেতৃত্ব তুলে আনা হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement