গার্মেন্ট কারখানা বন্ধের চেয়ে চালু হয়েছে বেশি
- শাহ আলম নূর
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:২০
- সরকারকে বিব্রত করতে অপপ্রচার অনেক গার্মেন্ট মালিকের
- চীন-মার্কিন অনিশ্চয়তার সুযোগ লুফে নিতে হবে বাংলাদেশকে
দেশে বেশ কিছু গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে বন্ধের তুলনায় নতুন কারখানা চালু হয়েছে বেশি। বন্ধের তুলনায় বেশি গার্মেন্ট কারখানা চালু হয়েছে বলেই রফতানিবাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি রাখা সম্ভব হয়েছে। তবে অনেক গার্মেন্ট মালিক উদ্যেশ্যমূলকভাবে গার্মেন্ট বন্ধের কথা বলছেন। যারা গার্মেন্ট বন্ধের কথা বলছেন তারা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করতে আওয়ামী লীগের দোসর কিছু ব্যবসায়ী গার্মেন্ট বন্ধের কথা অপপ্রচার করছেন।
দেশের গার্মেন্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন শ্রমিক অসন্তোষ ও বিভিন্ন কারণে গভীর সঙ্কটে দেশের গার্মেন্ট-শিল্প। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বেশ কিছু গার্মেন্ট কারখানায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। দেশের পোশাক খাতে অস্থিরতার তৈরির জন্য আওয়ামী সমর্থিত ব্যবসায়ী ও পাশের দেশ বড় ভূমিকা পালন করছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী ক্রেতারা শঙ্কিত হলেও নতুন কাজের অর্ডার নিয়ে আসছেন। বিপুল পরিমাণ কাজের অর্ডার থাকায় অনেক গার্মেন্ট মালিক তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করছেন। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারকে বিব্রত করতে বেশ কিছু ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। আসলে বিভিন্ন কারণে গার্মেন্ট বন্ধ হতে পারে। কারণ অনেকেই একটি সময় গিয়ে গার্মেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তারা গার্মেন্ট ব্যবসা বন্ধ করে অন্য ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন। এসব কারখানার যন্ত্রাংশ অন্য ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে নিচ্ছেন এবং নতুন কারখানা স্থাপন করছেন। আসলে কারখানা বন্ধ হচ্ছে না। মূলত মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গার্মেন্ট ব্যবায়ীরা কারখানা বন্ধের কথা বলছেন। তবে যেসব নতুন কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে তা প্রকাশ করছেন না। কয়েকজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্ট খাতের ব্যাপক অবদান রয়েছে। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এ খাতের ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। তারা বলছেন, দেশে গার্মেন্ট ব্যবসা চালু হওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীরা শুধু অভাবের কথা বলছেন। তারা সবসময় সরকারের কাছে নিজেদের অভাবের কথা বলে থাকেন এবং সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে থাকেন। কিছু ব্যবসায়ী বিপুলসংখ্যক গার্মেন্ট বন্ধের কথা বলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চাচ্ছেন। আসলে দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ নতুন কাজের অর্ডার রয়েছে তাতে অনেক গার্মেন্ট মালিক নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নতুন করে বিনিয়োগে যাচ্ছেন এটি হচ্ছে বাস্তবতা বলে তারা জানান।
সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ছয় মাসে বন্ধ হয়েছে তৈরী পোশাক খাতে ১০০টির বেশি কারখানা। একই সাথে এলসি, কাঁচামাল পাওয়ার সুযোগ কমে আসায় বন্ধের ঝুঁকিতে এক হাজার ১৫০ নন-বন্ডেড পোশাক কারখানা। তারা বলছেন সীমিত মূলধনের ছোট পোশাক কারখানাগুলো বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সের অভাব এবং ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র (এলসি) জোগাড় ও কাঁচামাল-অ্যাক্সেসরিজ কেনার জটিলতার কারণে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্স না থাকায় অনেক ব্যাংক মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ইস্যু করছেন না। এসব ব্যবসায়ী বলছেন, যেসব কারখানা বন্ধের আশঙ্কায় রয়েছে এমন প্রায় এক হাজার ১৫০টি কারখানায় সাত লাখ শ্রমিক কাজ করছেন এবং এসব কারখানার বার্ষিক সম্মিলিত রফতানি মূল্য প্রায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা যে বক্তব্য দিচ্ছেন আসলে তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। দেশের রফতানিবাণিজ্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে পোশাক রফতানি বেড়েছে ১২ শতাংশ। দেশের পোশাক কারখানা বন্ধ হলে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তথ্য বলছে, কেবল জানুয়ারিতেই পোশাক রফতানি আয় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ২৫ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে মোট রফতানি আয়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) প্রশাসক মো: আনোয়ার হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের গার্মেন্টস মালিকরা কারখানা বন্ধের বিষয়ে যেসব তথ্য দিচ্ছে তা ঠিক নয়। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে বেশ কিছু গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে থাকলেও নতুন বিনিয়োগ এসেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য রফতানিবাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। যেসব গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে বলে জানানো হয়েছে আসলে এসব কারখানা কাজের অভাবে বন্ধ হয়নি। অনেক কারখানামালিক ব্যবসা পরিবর্তন করেছেন। এ জন্য তারা গার্মেন্ট কারখানা পরিচালনা করতে ইচ্ছুক নন। তবে যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে তার যন্ত্রাংশ অন্য কারখানার মালিক কিনে নিয়ে আবার নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। বন্ধ হওয়ার কারণে যেসব শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন তারা অন্য কারখানায় গিয়ে নতুন করে আবার চাকরি শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে; কিন্তু কোনো গার্মেন্ট শ্রমিক বা কর্মকর্তা পাওয়া যাবে না যে চাকরি হারিয়ে বেকার বসে আছে। দেশে যদি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে থাকে তবে অনেক গার্মেন্ট শ্রমিককে বেকার অবস্থায় পাওয়ার কথা। যেহেতু কোনো বেকার শ্রমিক নেই তার মানে কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি বলে তিনি জানান।
এ দিকে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন- চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের কারণে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে বিশ্ববাণিজ্যে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা। এ সুযোগ কাজে লাগাতে অনেকেই নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। তবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সরকারে নীতি-কৌশল ব্যবসাবান্ধব করার ওপর জোর দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এমন বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির পথে হাঁটতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমেরিকার সাথে যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে তাতে দেশের গার্মেন্ট খাতে ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশের গার্মেন্ট রফতানি কয়েকটি কারণে বেড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, কর্মীদের দক্ষতা বেড়েছে। শ্রমিকরা আগের তুলনায় দক্ষ হওয়ার কারণে চালু থাকা বেশির ভাগ কারখানার উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। ব্যাংকের অসহযোগিতাসহ বেশ কিছু কারণে অনেক ছোট বা মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও বড় ও দক্ষ কারখানাগুলো উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে মোট রফতানি আয় কমেনি; বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার চীন, কানাডা ও মেক্সিকো। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চীন এক হাজার ৫২২ কোটি ডলার মূল্যের পোশাক, কানাডা ৪৭ কোটি ডলারের এবং মেক্সিকো ২৪১ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এই বাণিজ্য অংশীজনদের মধ্যে উত্তপ্ত হচ্ছে সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। বিপরীতে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয় কানাডা, মেক্সিকো ও চীনও।
এ দিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানান, ১৫৫ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে তার সরকার। প্রথম ধাপ শুরু হবে ৪ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় ধাপে বাকি ১২৫ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারের মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ হবে ২১ দিনের মধ্যে। শুধু তাই নয়, মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গুগলের বিরুদ্ধে আস্থা ভঙ্গের অভিযোগ এনে তদন্তেরও ঘোষণা দিয়েছে চীন। তবে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যে শুল্ক আরোপ এক মাসের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প। আলোচনা করবেন চীনের সাথেও। বিশ্ব-অর্থনীতির শীর্ষ দুই দেশ চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে কানাডা, মেক্সিকো জড়িয়ে পড়ায় মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী তৈরী পোশাক রফতানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য অনেক কারখানামালিক অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মো: হাতেম বলেন, সরকার যদি পলিসি ঠিক করে দেয়, তাহলে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটি কাজে লাগানো যাবে। তাই সময়োপযোগী পলিসি নিতে হবে। এতে দেশের রফতানি আগামী কয়েক বছরে ভালো অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ দিকে দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্যসুবিধা ভোগ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের চলতি মেয়াদেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। কারণ চীন-মার্কিন অনিশ্চয়তা সামনে বাড়তে পারে। আর এতেই সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশের জন্য, যা লুফে নিতে হবে। এ দিকে রফতানি আয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশ তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় রফতানিবাজার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা