৬ মাসে রাজস্ব আদায় ২৭ শতাংশ কম
- শাহ আলম নূর
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চাপে পড়ে গেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার পরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ের চেয়েও এ অর্থ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা কম।
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) আয়কর, মূসক ও শুল্ক তিন খাত মিলিয়ে মোট দুই লাখ ১৪ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। উল্লিখিত সময়ে আদায় হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা কম।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বড় প্রকল্পগুলোতে অর্থ ছাড় কমে যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণে রাজস্ব আদায় কমেছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়া একটা বড় কারণ। তবে এর রেশ কাটিয়ে গত অক্টোবর থেকে রাজস্ব আদায়ে কিছুটা গতি বেড়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আগের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। বিভিন্ন উদ্যোগের পরও চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় এক লাখ ৫৭ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবারের ছয় মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে এক হাজার ৫১৬ কোটি টাকা, যার ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে নেতিবাচক। এ দিকে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও রাজস্ব আদায়ে নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত জুনে প্রস্তাবিত মূল বাজেটে সামগ্রিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সামনে রেখে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায় করার কথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। এখন নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রার কারণে রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সংস্থাটির তথ্যে দেখা যায়, আয়কর ও শুল্ক খাতে সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও মূসক বা ভ্যাট খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। আয়কর খাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৬৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যেখানে আদায় হয়েছে ৫২ হাজার ১৬২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫০ হাজার ৮৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, অর্থাৎ এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
কাস্টমস বা শুল্ক খাতে প্রথমার্ধের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা; কিন্তু আদায় হয়েছে ৪৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে একই সময়ে সংগ্রহ হয়েছিল ৪৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ০ দশমিক ৬১ শতাংশ। তবে ভ্যাট বা মূসক খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৩১৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা; কিন্তু আদায় হয়েছে ৫৫ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, ফলে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এই ছয় মাসে এনবিআর ১২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা শুল্ক, ২১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মূসক এবং ২৩ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা আয়কর সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজস্ব আহরণে বেশ কিছু সমস্যা থাকায় সরকারি কোষাগার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, টিআইএন থাকা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছে না। সরকার করদাতাদের প্রদত্ত কর পাচ্ছে না। এ দিকে এনবিআর করের জাল প্রসারিত না করে কেবল বিদ্যমান করদাতাদের কাছ থেকে কর আদায় করছে। আবার অনেকে তাদের আয় অনুসারে কর দিচ্ছে না। এসব কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ দিকে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ নয়া দিগন্তকে বলেন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে এনবিআর কেন ব্যর্থ হচ্ছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। একই সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওয়তায় আনতে হবে। এ দিকে রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছোট করা উচিত হবে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী ব্যয়ের বাজেট বাড়াতে হবে। একই সাথে অর্থনীতিতে নতুন বিনিয়োগ আনতে হবে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আগে অযৌক্তিকভাবে, বিনা প্রয়োজনে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বাজেট বাড়ালেও মানসম্মত ব্যয় নিশ্চিত করতে পারেনি বলে তিনি মনে করেন।
এ দিকে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ দেশের যে ক্ষতি করে দিয়েছে, তাতে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ।