০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`
বৈষম্যবিরোধী-বীরত্বগাঁথা

গুলিবিদ্ধ সানজিদার চিকিৎসা থমকে আছে টাকার অভাবে

-

আমাগো বাসার কাছাকাছি একটা ক্লিনিকে আগুন লাগে, পুলিশ মানুষেরে গুলি করে, মানুষ পুলিশের মারে ঢিলা। অনেক ঝামেলা চলতাছিল রাস্তায়। চারপাশে উড়তেছিল হেলিকপ্টার। আমার নাতিনডা বারান্দায় দাঁড়ায়ে ছিল। বারান্দায় দাঁড়াইয়া রাব্বি (সাবলেট ভাড়াটিয়া) আর ওয় বাহিরের এসব দেখতাছিল। এর মধ্যে হঠাৎ আমাগো বিল্ডিংটায় খই যেমনে ফুটে, এমন আওয়াজ হওয়া শুরু হইল। আমি ডরে শেষ। এর মধ্যে বারান্দা থেকে আমার মাইয়া ডাইনিং রুমে আইসা নিচে পড়ে গেল। মাইয়া বলে, মাগো আমার পিঠডা ঢলায় দেও। পিছনে তাকায় দেখি রাব্বি মাটিতে পইড়া আছে। কিছু বুঝার আগেই দেখি দু’জনের রক্তে ঘর ভাইসা গেছে। হাউমাউ করে চিৎকার করা শুরু করলাম। যখন মাইয়ার চোখ উল্টায় গেল, মনে করছি মাইয়া আর পৃথিবীতে নাই। মানুষে মানুষে আমাগো বিল্ডিং ভরে গেল। কিন্তু কোনো একটা মানুষ আমাগো সাহায্য করে নাই। সবাই ভয়ে যার যার ঘরে চইলা গেল।
কথাগুলো বলেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে আহত সানজিদা ইসলামের (২০) মা আমেনা বেগম গত ২০ জুলাই বিকেলে তার ঘরে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবেই।

আহত সানজিদা সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল এলাকার বাসিন্দা। ওই এলাকার স্থানীয় নজরুল ইসলামের ছয়তলা বাড়িতে ভাড়া থাকেন। স্বামী মো: রানার (৩০) সাথে বিচ্ছেদের পর মায়ের সাথে বসবাস করেন। তার বাবা নেই। সানজিদার মা আমেনা বেগম (৪০) গৃহকর্মীর কাজ করেন। সানজিদা ও তার পাঁচ বছরে মেয়ে মিমকে নিয়েই তার পরিবার। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আহত সানজিদা বলেন, বাড়ির পাশের বিল্ডিংয়ে হঠাৎ আগুন লাগে। পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি ছুড়লে সবাই আমাদের বাসার নিচে আসতাছিল। বাইরের পরিস্থিতি দেখে ভয়ে আমি মিমকে বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে আনতে গিয়েছিলাম। ওরে নিয়ে যেই আমি রুমের ভেতরে ঢুকতে যাই, তখনি আমার কোমরে গুলি লাগে। কিডনি থেকে আধা ইঞ্চি নিচে আমার গুলি লাগছে। আমার যা হওয়ার হইছে, আল্লায় আমার মাইয়াটারে বাঁচাইছে। কয়েক সেকেন্ড আগে হলে এই গুলি আমার মাইয়ার গায়ে লাগত। মেয়ের যেন কিছু না হয় তাই তাকে আনতে গিয়েছিলাম। কে জানত নিজের ঘরে থেকেও গুলি খেতে হবে। আমি তো গুলি লাগার পর ডাইনিং রুম পর্যন্ত আসতে পারছি, কিন্তু আমাদের সাবলেট রাব্বি ভাই সাথে সাথে সেখানেই মারা গেছেন।

সানজিদার মা আমেনা বেগম বলেন, মেয়েরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাইতেও অনেক কষ্ট হইছে। রিকশাওয়ালারাও ভয়ে যাইতে চায় নাই। বড় রাস্তায় তো ঝামেলা, গলি দিয়ে মাইয়ারে সাইনবোর্ডের একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়া গেলাম। ওখানের ডাক্তাররা মাইয়াটারে দেখতেও চায় না। তারা ঘণ্টাখানেক পরে ওর কাছে আসল, আইসা বলে ওর পেটে গুলি নাই। আমি কাইন্দাকাইট্টা বললাম, একটা এক্স-রে করেন। পরে এক্স-রে করে দেখে গুলি আছে। এরপর তারা গুলি বের করে। বাসায় নিয়া আইলাম মাইয়ারে। অন্ধকার ঘরে তখনো রাব্বির লাশ মাটিতে পড়ে আছে। রাত ৩টা পর্যন্ত রক্তাক্ত লাশের সামনে বইসাছিলাম। শেষ রাতে জামালপুর থেকে রাব্বির পরিবারের মানুষ আইসা ওর লাশ নিয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, ‘গুলি লাগার ১১ দিন পরও অতিরিক্ত ব্যথায় চিৎকার পারত মাইয়াটা। পরে ডাক্তার বলল, পেটে গুলির বারুদ আছে। অপারেশন করা লাগবে। ডাক্তার বলছে, ওর সুস্থ হইতে অনেকদিন সময় লাগবে। এখনো প্রায়ই ব্যথায় ছটফট করে।

এদিকে অর্থের অভাবে থমকে আছে সানজিদার চিকিৎসা। এখন পর্যন্ত সানজিদার চিকিৎসা বাবদ প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন আমেনা বেগম। সম্প্রতি চিকিৎসক তার শারীরিক অবস্থা দেখে রোগনির্ণয়ে পরীক্ষার পরামর্শ দেন। কিন্তু অর্থের অভাবে পরীক্ষা না করিয়ে পরিচিত ফার্মেসি থেকে ধারে ব্যথানাশক ওষধ খাচ্ছেন সানজিদা।
সানজিদা বলেন, প্রায় সময় পেটে প্রচুর ব্যথা হয়। ব্যথায় জ্বর চলে আসে। এজন্য ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে বলেছে। কিন্তু পরীক্ষা করার জন্য টাকা নাই। বেশি ব্যথা করলে ফার্মেসি থেকে ধারে এনে ওষুধ খাচ্ছি।’
আমেনা বেগম বলেন, আমরা কোনো রকমে খাইয়া পইরা ভালোই ছিলাম। কিন্তু ধার-দেনা করে ওর চিকিৎসা করে আমি এখন নিঃস্ব। কোনো আত্মীয়স্বজন আমারে তেমন উপকার করে নাই। আমি আর চিকিৎসা করাতে পারতাছি না। ঢাকার কোনো হাসপাতাল আমি চিনিও না। আমার মেয়ের মতো যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে তাদের সব চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব সরকারের নেয়ার দাবি জানাই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ২০ হাজার টাকা আর জামায়াত ইসলাম থেকে ১০ হাজার টাকার সাহায্য পাওয়ার কথা জানান তিনি।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘এই টাকা মেয়ের চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেছে। ওর চিকিৎসা করতে আরো টাকা লাগবে। আমার বয়স হয়েছে, চিকিৎসা না করতে পারলে আমার মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়? আমার নাতিনের মা ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ নাই।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল