জনস্বার্থ উপেক্ষা করে ড্যাপ সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে : আইপিডি
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৭
ঢাকার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের ক্ষেত্রে ঢাকার বাসযোগ্যতা এবং সামগ্রিক জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ প্রাধান্য পাওয়ার কথা। অথচ আবাসন ব্যবসায়ী, ভবন ডিজাইন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের প্ররোচনায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জনস্বার্থ ও ঢাকার বাসযোগ্যতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও ড্যাপ সংশোধনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শকে একদমই আমলে না নিয়ে স্বেচ্ছাচারীভাবে এই কার্যক্রম চলছে। বিবেচনাহীনভাবে এলাকাভিত্তিক ও প্লটভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) এবং জনঘনত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক, যাতে এরই মধ্যে যানজট ও বায়ুদূষণে প্রায় অচল ও মৃতপ্রায় এই শহরের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউকের অপরিণামদর্শী এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে কোন উদ্দেশ্য ও কার স্বার্থ কাজ করছে, সেটির নির্মোহ তদন্ত করতে হবে সরকারকে। ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে পরিকল্পনাবিদদের কারিগরি পরামর্শ এবং সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করেই ইমারত বিধিমালা ও ড্যাপের যৌক্তিক সংশোধন করবার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
গতকাল ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) অনলাইনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পরিকল্পনাবিদরা এ অভিযোগ করেন। আলোচনার প্রতিপাদ্য ছিল ‘বসবাসযোগ্যতায় তলানিতে থাকা ঢাকার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্যে ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব : আইপিডির পর্যবেক্ষণ।’
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডি পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজউক কর্তৃক খসড়াকৃত ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় এবং ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর-সংক্রান্ত সংশোধন প্রস্তাবনায় পরিকল্পনাবিদদের মতামতের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি, যা খুবই হতাশাজনক এবং বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে কাজ করবে। অতীতে বিভিন্ন ব্যবসায়িক স্বার্থগোষ্ঠী শহরের পরিকল্পনা ও ইমারত বিধিমালাকে অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে, যার ফলে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা ক্রমেই তলানির দিকে গিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশেও ইমারত বিধিমালা এবং ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের নামে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছে, যা শহরের বাসযোগ্যতা, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থকে আরো হুমকিতে ফেলবে। এই তৎপরতায় সরকারি কিছু কর্মকর্তার পাশে কিছু পেশাজীবীও যোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তদন্তসাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিকল্পনা পেশাজীবীদের দেয়া প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব না দিয়ে কাদের প্রস্তাবনায় এবং কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে এ ধরনের পরিবর্তন করা হচ্ছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় আবাসিক ভবনের জন্য মোটা দাগে রাস্তার প্রশস্থতা ও প্লটের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন ‘এফএআর’ মান ৩.১৫ ও সর্বোচ্চ ৬.৫ দেয়া হয়েছিল। বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসিক এ৩ (ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট) শ্রেণীর জন্য এই মান সর্বোচ্চ ৪.২৫ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা মে’ ২০২৪ সালে খসড়া ইমারত বিধিমালায় অনুসরণ করা হয়েছিল। অথচ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে রাজউক কর্তৃক প্রণীত ইমারত বিধিমালার খসড়াতে প্লটভিত্তিক আবাসিক এ৩ ক্যাটাগরির ফার মান ৫.৫ করা হয়েছে, যা প্রায় অবাসযোগ্য ঢাকা শহরের ওপর চাপ মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেবে। অথচ বৈশ্বিকভাবেই ছোট আয়তনের প্লটভিত্তিক আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে ফার মান সাধারণত ১ থেকে ৩ এর মধ্যেই হয়ে থাকে। ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ফার ও জনঘনত্ব দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রাজউক। অথচ সেসব এলাকার নাগরিক সুবিধাদি একই থাকছে। গোষ্ঠীস্বার্থে বিধিমালার ফার মান পরিবর্তন শহরের জন্য বাসযোগ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ বিবেচনায় নিয়ে ফার মান সাধারণত থাকে ১-৩ এর মধ্যে; অথচ প্রস্তাবিত বিধিমালায় ফার মান সর্বোচ্চ ৬, ৭, এমনকি এনএর বা নিয়ন্ত্রণহীন ফার মান প্রস্তাব করা হয়েছে।
নগর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নগর এলাকার ধরন, মান ও অবস্থান অনুযায়ী পরিকল্পনার কৌশল, জনঘনত্ব, ফার মান, উচ্চতা সীমা প্রভৃতি ভিন্ন হয়ে থাকে। ২০২৪ সালের শুরুতে প্রস্তুতকৃত খসড়া ইমারত বিধিমালায় আবাসিক এলাকার ফার মান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে কেন্দ্রীয় ঢাকা, বহিঃস্থ নগর ও অন্যান্য নগর এলাকার জন্য পৃথক ফার মান দেয়া হয়েছিল। এটি অত্যন্ত বিস্ময়কর যে বর্তমান ইমারত বিধিমালা প্রস্তাবনায় এই এলাকাভিত্তিক প্রস্তাবনা বাদ দেয়া হয়েছে। ভবনের সেটব্যাক দূরত্ব যথাযথ করে ভবনের ভেতর প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলের বিষয়টিও উপেক্ষিত বিধিমালার প্রস্তাবনায়।
অনুষ্ঠানে আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউক বারবার পরিকল্পনার মানদণ্ডের সাথে আপস করে পরিকল্পনা ও ইমারত সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান করছে। মেরুদণ্ডহীন ও দুর্বল এই রাজউকের সংস্কার করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, সমগ্র পৃথিবীতেই পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইন মেনেই রিয়েল এস্টেটকে ব্যবসা করতে হয়। পরিকল্পনাকে শ্রদ্ধা না করে পরিকল্পনাকে নিজস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রভাবিত করবার এ ধরনের অপচেষ্টা হলে দেশে পরিকল্পনা করবারই প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রের। সভায় হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ সেন্টারের (এইচবিআরসি) নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাদেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা