২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৩ রজব ১৪৪৬
`
বিচার চান শিল্পীরা

চলচ্চিত্রপাড়ায় নিপুণকে নিয়ে তোলপাড়

চলচ্চিত্রপাড়ায় নিপুণকে নিয়ে তোলপাড় -

চলচ্চিত্র নায়িকা নিপুণকে নিয়ে চলচ্চিত্র পাড়ায় এখন ঝড় বইছে। কী করেননি নিপুণ আক্তার এমন হিসাব করলে বাদ পড়ার তালিকাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নিজের আখের গোছাতে এমন কিছু নেই যা তিনি করেননি। তবে এর পেছনে মাফিয়া ডন ছিলেন আওয়ামী লীগ শেখ পরিবারের সদস্য শেখ সেলিম ও দলের কিছু সাঙ্গপাঙ্গ। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই আওয়ামী শাসনের ১৬ বছর বেপরোয়া ছিলেন নিপুণ। ঘন ঘন বিদেশ সফর ও বনানীতে পার্লারের আড়ালে ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ড’ অনেকটা প্রকাশ্য ছিল। এর বাইরে তদবির বাণিজ্য, শেখ সেলিমের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় ও শিল্পী সমিতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে তিনি ছিলেন মাফিয়া। যার শক্তিতে তিনি শিল্পী সমিতির কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারও দখল করেছেন। এখানেই শেষ নয়, সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদেরও তিনি এক মন্ত্রীর ভয় দেখিয়ে হুমকি দিতেন। তার এমন ক্ষমতার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেননি। সর্বশেষ হাসিনা সরকারের পতনের পর পলাতক নিপুণকে শিল্পী সমিতি থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।
নিপুণের ঘনিষ্ঠ একজন জানান, নিপুণ সব সময় টাকার পেছনে ঘুরতেন। এজন্য যখন যা প্রয়োজন তাই করতেন। নাসরিন আক্তার নিপুণ ২০০৬ সালে এফ আই মানিক পরিচালিত ‘পিতার আসন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় পা রাখেন। নায়িকা হওয়ার বয়সেই তিনি যে ক’টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তার একটাও আলোচনায় আসতে পারেননি। এ নিয়ে নির্মাতারা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এ ছাড়া ‘নৈতিক স্খলনে’ ২০০৬ সালে স্বামী থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সে সময় তার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন অপু আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সাথে নিপুণের বিশেষ সম্পর্কের অভিযোগ তোলেন।

২০১৭ সালে নিপুণ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির কার্যনির্বাহীর সদস্যপদ লাভ করেন। ২০২২ সালে কাঞ্চন-নিপুণ পরিষদ থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সে নির্বাচনে নায়ক জায়েদ খানকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলেও শেখ সেলিমের শক্তি কাজে লাগিয়ে তিনি জোরপূর্বক নির্বাচনের ফলাফল পাল্টাতে নির্বাচন কমিশনকে চাপ সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে নির্বাচন কমিশন জায়েদ খানকে বাদ দিয়ে নিপুণকে বিজয়ী ঘোষণা করে। এতে জায়েদ খান আইনের আশ্রয় নিলেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিপুণ সেই চেয়ার দখলে রাখেন।
এরপর ২০২৪-২৬ নির্বাচনে তিনি আবার সাধারণ সম্পাদক পদে ডিপজলের বিপরীতে নির্বাচন করেন। তাতে ডিপজলকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলে প্রথমে তিনি ফলাফল মানলেও দুই সপ্তাহ পর অনিয়মের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল এবং নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেন। এর আগে ২০১৬ সালে রাজধানীর বনানীতে ‘টিউলিপ নেইলস অ্যান্ড স্পা’ নামের পার্লার খোলেন। যার উদ্বোধন করেন শেখ সেলিম। এরপর জানা যায়, এই পার্লারটি শেখ সেলিম উপহার হিসেবে নিপুণকে দিয়েছেন।
জানা যায়, পার্লারের বাইরেও শেখ সেলিমের নাম ব্যবহার করে নিত্য নতুন গাড়ি, বিদেশভ্রমণসহ মোটা অঙ্কের টাকা নিপুণ বিশেষ ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন। তার জন্য অনেকের সাথে বছরের বেশির ভাগ সময় বিদেশে কাটাতেন। আর নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে শিল্পী সমিতির চেয়ার ধরে রাখতে মরিয়া ছিলেন।

একাধিক সাংবাদিক অভিযোগ করেন, এফডিসিতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে নিপুণকে সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করতেন তখন কোনো প্রশ্ন তারা পছন্দমতো না হলে তিনি প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের নাম নিয়ে হুমকি দিতেন। বলতেনÑ বেশি বাড়াবাড়ি করলে মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করবেন।
অন্য দিকে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয় শিল্পীদের একটি অংশ। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন নিপুণ। এ সময় তিনি শিল্পী সমিতির দায়িত্বে না থেকেও ১৭ জুলাই ভোরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির অফিসিয়াল প্যাড ব্যবহার করে তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। শিল্পী সমিতির কমিটিতে না থেকেও সমিতির অফিসিয়াল প্যাড ব্যবহার করে তার এমন বিবৃতি নিয়ে চলচ্চিত্র পাড়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এ অবস্থায় চলতি মাসে সিলেট হয়ে লন্ডন পালানোর সময় তাকে বিমানবন্দরে আটকে দেয়া হয়। ফলে লন্ডন যেতে ব্যর্থ হন।
সর্বশেষ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিতে নিপুণের সদস্যপদ স্থগিত করে তাকে শিল্পী সমিতিতে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। ১৯ জানুয়ারি সংগঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদের ১২তম সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সদস্যপদ স্থগিতের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাতে তার বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ আনা হয়।
নিপুণের এমন কর্মকাণ্ডে শিল্পী সমিতির একাধিক নেতা ও সিনিয়র শিল্পীরা বলছেন, বিগত দেড় যুগ নিপুণ যা করেছেন তা শিল্পী সমাজের জন্য কলঙ্ক। তার এ অপরাধের দায় শিল্পী সমাজ নেবে না। কারণ অনৈতিক কাজ সমাজ-শিল্পকে ধ্বংস করে। এজন্য যার পাপ তার কলঙ্ক তাকেই বহন করতে হবে। আর এমন যাতে আর না ঘটে এজন্য তার বিচার করতে হবে। এ বিষয়ে জানতে গতকাল নিপুণের মোবাইলে ফোন করলে তার দু’টি নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।


আরো সংবাদ



premium cement