উচ্চ আদালতের বিচারক যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হবে
- হাবিবুর রহমান
- ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:৪৯
স্বাধীনতার প্রায় ৫৪ বছর পর দলীয় বিবেচনার বাইরে স্বচ্ছপ্রক্রিয়ায় যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে দেশে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল করেছে সরকার। আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নীতিমালা ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো আশ^াস দিয়েছে ও ওয়াদা করেছে যে বিচারক নিয়োগে আইন করবেন। কিন্তু করেনি। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে বহু কাক্সিক্ষত সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ আইন হলো।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে ২১ জানুয়ারি অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শীর্ষক এ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই ও প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ প্রদানের উদ্দেশ্যে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি হবেন সাত সদস্যের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের এই কাউন্সিলের চেয়ারপারসন। কাউন্সিলের সদস্যরা হলেন, আপিল বিভাগে কর্মে প্রবীণতম বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগে কর্মে প্রবীণতম বিচারক, বিচারকর্ম বিভাগ (নি¤œ আদালত) থেকে নিযুক্ত হাইকোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারক, চেয়ারপারসনের মনোনীত আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং চেয়ারপারসনের মনোনীত একজন আইনের অধ্যাপক বা আইন বিশেষজ্ঞ। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত সদস্যের এই কাউন্সিল যাচাই বাছাই করে বিচারক নিয়োগের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। তবে রাষ্ট্রপতি চাইলে কারণ উল্লেখ করে কাউন্সিলের সেই সুপারিশ থেকে কারো নাম ফেরত পাঠাতে পারবেন। অধ্যাদেশে কাউন্সিল গঠন, বিচারক পদে আবেদনের যোগ্যতা ও আবেদন ফরমসহ বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা রয়েছে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা : অধ্যাদেশের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ প্রদানপ্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতিকে সহায়তা করতে এই অধ্যাদেশ অনুসারে উপযুক্ত বাছাই করে সুপারিশের জন্য একটি স্থায়ী কাউন্সিল থাকবে, যার নাম হবে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এই কাউন্সিলের সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
কাউন্সিলের সভা : অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের অন্যান্য বিধানাবলি সাপেক্ষে, কাউন্সিল সভার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবে। কাউন্সিলের সব সভা চেয়ারপারসনের নির্ধারিত স্থান ও সময়ে অনুষ্ঠিত হবে।
তবে শর্ত থাকে যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিচারকের সংখ্যা নির্ধারণ করতে রাষ্ট্রপতির অনুরোধ এলে প্রধান বিচারপতি অবিলম্বে কাউন্সিলের সভা আহ্বান করবেন।
কাউন্সিলের ক্ষমতা ও কার্যাবলি : কাউন্সিল, এই অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাই করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের সুপারিশ প্রণয়ন করবে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ ও ৯৮ এর অধীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগের জন্য কাউন্সিল সংবিধানে বর্ণিত যোগ্যতার সম্পূরক হিসেবে কয়েকটি বিবেচনা করবেন। সেগুলো হলো- প্রার্থীর বয়স ৪৫ এর নিচে হবে না; প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ; আইনের কোনো নির্দিষ্ট শাখায় প্রার্থীর বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা; প্রার্থীর সামগ্রিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা, সুনাম, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়; কোনো ফৌজদারি মামলায় প্রার্থীর দণ্ড সম্পর্কিত তথ্য এবং কাউন্সিলের নির্ধারণ করা অন্যান্য বিষয়।
অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে সুপারিশ: অধ্যাদেশের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৮ এর অধীন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগের উদ্দেশ্যে, এই অধ্যাদেশের অন্যান্য বিধানাবলি সাপেক্ষে, কাউন্সিল-উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় তথ্য নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করিতে পারবে; এ ছাড়াও ফরমে প্রার্থীদের নিকট হতে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরখাস্ত আহ্বান করবে। সংবিধান, অধ্যাদেশ ও অন্যান্য বিধানের আলোকে নিজ উদ্যোগে সংগৃহীত তথ্যাদি এবং দাখিলকৃত দরখাস্ত যাচাই-বাছাই করবে। যাচাই বাছাই করে কাউন্সিলের বিবেচনায় যোগ্য প্রার্থীদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত এবং সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেবে। এরপর একটি তালিকা সুপারিশ আকারে প্রণয়ন করবে।
আর হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক (স্থায়ী) নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান ও অধ্যাদেশ অনুসারে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। তবে ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ এবং ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে অনুপযুক্ত হলে কাউন্সিল ওই বিচারককে নিযুক্ত করার সুপারিশ করা থেকে বিরত থাকবে।
আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ : ৮ ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ এর আওতায় আপিল বিভাগের বিচারক পদে নিয়োগের উদ্দেশ্যে, এই অধ্যাদেশের অন্যান্য বিধানাবলি সাপেক্ষে, কাউন্সিল আপিল বিভাগে নিয়োগযোগ্য বিচারকের শূন্যপদের সংখ্যার আলোকে হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত জ্যেষ্ঠ বিচারকদের যোগ্যতা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ধারা ৬ এর উপ-ধারা (২) ও উপধারা (৩) এর দফা (গ) এবং সংশ্লিষ্ট বিধানাবলিতে উল্লিখিত বিষয়াদি বিবেচনা করিবে; এরপর একটি তালিকা সুপারিশ আকারে প্রণয়ন করবে।
রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ : অধ্যাদেশের ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কাউন্সিলের প্রণীত সুপারিশ প্রধান বিচারপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ এর দফা (১) অনুসারে পরামর্শরূপে রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠাবেন। ১১ ধারা অনুসারে, পরামর্শ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি সুপারিশকৃত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ দেবেন অথবা, ক্ষেত্রমতো, প্রধান বিচারপতির পরামর্শ কার্যকর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শের সহিত দ্বিমত পোষণ করলে তিনি সংশ্লিষ্ট তথ্য এবং কারণ উল্লেখ করে বিষয়টি পুনঃনিরীক্ষণের জন্য প্রধান বিচারপতির নিকট পাঠাতে পারবেন। পুনঃনিরীক্ষণের অনুরোধ এলে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব কাউন্সিলের নিকট উপস্থাপন করবেন।
এরপর কাউন্সিল বিষয়টি পুনঃনিরীক্ষণ করে সংশোধিত আকারে সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারবে অথবা যথাযথ তথ্য ও কারণ উল্লেখ করে প্রেরিত আগের সুপারিশ কোনো সংশোধন ব্যতিরেকে আবার গ্রহণ করবে।
প্রতিক্রিয়া : এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, এখানে কোনো আইনজীবী প্রতিনিধি নাই। তিনি বলেন, অতীতে আমরা দেখেছি সব কিছুতে আইনজীবীদের প্রতিনিধি থাকে। তার কারণ এই আদালত পরিচালনা করেন আদালত ও আইনজীবীরা। অথচ এখানে আইনজীবীদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। আইনজীবী প্রতিনিধি অবশ্যই রাখা উচিত ছিল। তিনি আরো বলেন, যারা এই অধ্যাদেশ করেছেন তারা বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রতিনিধি এটা অবশ্যই রাখার জন্য চিন্তা করবেন, যদি এটাকে ইফেকটিভ করতে চান।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের যে আইন হয়েছে সেটা দীর্ঘদিনের দাবি। স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্য পূর্বশর্ত হলো বিচারপতি নিয়োগের আইন করতে হবে। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। এর আগে বিচারপতি নিয়োগে গাইডলাইন ছিল না। এই আইনের মাধ্যমে গাইডলাইন হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বা ৫৪ বছর পর অন্তর্বর্তী সরকার এই আইনটা করেছে। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের দাবি, আইনজীবীদের দাবি এবং উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নীতিমালা ছিল না। অনেক সময় অনেক রাজনৈতিক দল আশ^াস দিয়েছে। ওয়াদা করেছে যে বিচারক নিয়োগে আইন করবেন। এবং দীর্ঘদিন থেকে দেশের মা নুষ দাবি জানিয়েছে। তবে আইনটা ট্রান্সপারেন্ট হয়নি বলে দাবি করেন ব্যারিস্টার খোকন। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের আইন কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। আমার মনে হয় এখানে একটা শূন্যতা আছে। এখানে বিচারকদের প্রতিনিধি আছে কিন্তু আইনজীবীদের কোনো প্রতিনিধি নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা