কারিগরি শিক্ষাকে আবশ্যিক করে প্রস্তুত হচ্ছে কোর্স কারিকুলাম
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হচ্ছে আইসিটি ও নার্সিং এডুকেশন- শাহেদ মতিউর রহমান
- ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১২
উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে আবশ্যিক হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। এ লক্ষ্যে নতুন করে প্রস্তুত করা হচ্ছে বিভিন্ন কোর্সের কারিকুলাম। ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ও পাস কোর্সের শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দু’টি টেকনিক্যাল কোর্স চালুর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষ (২০২৩-২৪) থেকে সম্ভব না হলেও আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই নতুন দু’টি কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র। এদিকে দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমিয়ে আনতে এবং দেশে এবং বিদেশে দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন করে শিক্ষা কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনার চিন্তা করছে সরকার।
সূত্র মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স ও ডিগ্রিতে এক বছরের কারিগরি শিক্ষা চালুর চিন্তা করছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ থেকেই এ বিষয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমিয়ে বৃত্তিমূলক আত্মকর্মসংস্থান বাড়াতেই সম্মিলিকভাবে এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও ইউনিসেফ জানিয়েছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং বেকারত্বের হার কমিয়ে আনতে যেকোনো দেশেই বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
অবশ্য ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভাতেও নতুন দু’টি টেকনিক্যাল কোর্স চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রথম দফায় আইসিটি এবং নার্সিং এডুকেশন এই দু’টি কোর্স চালুর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভাতেও অনুমোদন হয়েছে। সূত্র মতে, দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমবেশি ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাই এই ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে আবশ্যিকভাবে টেকনিক্যাল শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে নিশ্চিতভাবেই দেশে বেকারত্বের হার কমবে। পাশাপাশি বিদেশে জনশক্তি রফতানিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক মো: নুরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, দেশে এবং বিশ্ব শ্রমবাজারের চাহিদা বিবেচনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম অবস্থায় দু’টি বিষয়ে নতুন টেকনিক্যাল কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলামেও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। বিশেষ করে আইসিটি এবং নার্সিং এই দু’টি বিষয়কে আমরা আমাদের কোর্স কারিকুলামে যুক্ত করছি। চলতি শিক্ষাবর্ষে সম্ভব না হলেও আগামী শিক্ষাবর্ষে আমরা নিঃসন্দেহে এই কোর্স দু’টি চালু করতে সমর্থ হবো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম গত মঙ্গলবার জানান, কারিগরি শিক্ষা নিয়ে আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। বিশ্ববাজারের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা অনুভব করছি কারিগরি শিক্ষাই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। কারিগরি শিক্ষা ছাড়া দেশের এত বেশি বেকারত্ব দূর করা সম্ভব নয়। তাই কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বাড়াতে হবে। তা না হলে আমরা উন্নতি করতে পারব না। সচিব আরো জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামে-গঞ্জে অনার্স-মাস্টার্স দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান ভালো আছে। কিন্তু সার্বিকভাবে কিছু চিন্তা করলে দেখা যাবে দেশে অনেক শিক্ষিত বেকারও সৃষ্টি করছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেক প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার মানও সন্তোষজনক নয়। ফলে তারা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে না ফিরে যেতে পারছে তাদের বাবার পেশায়, না পাচ্ছে কোনো চাকরি। ফলে বেকার তৈরি হচ্ছে। এখানে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। যদিও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কিছুটা নেতিবাচক ধারণা আছে। আমাদের সেগুলো দূর করতে হবে। যখন দেখবে কলেজে অনার্স পড়ানোর চাইতে কারিগরিতে পড়লে একটা কর্মসংস্থান হবে। তখন কারিগরি শিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীরাই বেশি আগ্রহী হবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থটের (বিআইআইটি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুহাম্মদ আবদুল আজিজ মনে করেন জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে শিক্ষাদর্শন, ভিশন, মিশন এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঠিক করাই এখন জরুরি। দেশীয় সত্তা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে, কল্যানমুখী রাষ্ট্র্র বিনির্মাণে, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন, দক্ষ এবং ভালো মানুষ গড়ে তোলাই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। তিনি বলেন, দেশের শ্রমবাজার এবং বিশ্বশ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিপ্লোমা চালু করা উচিত, যাতে করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়। এ ছাড়া কারিগরি ধারায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করার জন্য কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্প্রসারণ, গবেষণা কার্যক্রম এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে জেলাভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কারিগরি শিক্ষার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করাও সময়ের দাবি।
অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রমে অবশ্যই বাংলা, ইংরেজি এবং আরবিÑ তিনটি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে (আরবি পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা, একই সাথে দেশের একটি বিশাল জনশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত)। এ ছাড়াও সকল স্তরের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিতে জীবনমুখী দক্ষতা এবং বিষয়ভিত্তিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের যথাযথ সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ আরো মনে করেন আমাদের দেশের শিল্প এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর সাথে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগ চালু ও শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা, যাতে করে আমাদের দেশকে ভিন্ন দেশ থেকে লোক নিয়োগ করতে না হয় । যে বিষয়ে আমাদের দক্ষ জনশক্তি দরকার, সেই পরিমাণ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। একইসাথে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সঙ্কট মোকাবেলায় দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন, পরবর্তীতে শিক্ষা কমিশন গঠন অথবা জাতীয় করতে হবে। যেখানে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, দেশের শিল্প এবং শ্রমবাজারের সাথে পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।